চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

গণমাধ্যমে পেশাদারিত্ব ও সাংবাদিকতার অনিশ্চিত যাত্রা

দৈনিক সকালের খবর পত্রিকার অফিসটি আমাদের অফিস লাগোয়া। ফলে ওই পত্রিকার কর্মী এবং আমরা ফুটপাথের একই দোকানে চা খেতাম। সাংবাদিক নেতা হেলাল ভাইয়ের সাথে ইয়ার্কি-মশকরা হতো। বস্তুত সকালের খবরের কয়েকজন রিপোর্টার আমাদের চায়ের আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। সেই মানুষগুলো এখন বেকার। চাকরি না পেলে আগামী মাস থেকে অনেককেই হয়তো বাকিতে চা খেতে হবে। আগামী মাস থেকেই তারা আর আমাদের সাথে এই ফুটপাথে একসঙ্গে চা খাবেন না। এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন।

বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) হঠাৎ করেই সংবাদটি আসে যে, সকালের খবর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকসহ কর্মীর সংখ্যা তিনশোর বেশি। এর কিছুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল যমুনা নিউজ।

দেশের গণমাধ্যমের এই সংকট নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সহকর্মী জানালেন, দুই মাস ধরে তাদের বেতন বন্ধ। দৈনিক ইনকিলাবের কর্মীরা বছরের পর বছর বেতন পান না। দাবি আদায়ে তারা রাজপথেও নেমেছেন। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? ইংরেজি দৈনিক অবজারভারেরও একই অবস্থা ছিল। যদিও সেটি নতুন করে আবার প্রকাশিত হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যখন দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হলো, তখনও অনেক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই এখনও বেকার। অনেকে হয়তো পেশা বদলে ফেলেছেন। আবার এই পত্রিকাটির একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা ও তকমা থাকায় এর কর্মীদের পক্ষে অন্য কোথাও চাকরি পাওয়ায় বেশ কঠিন। যেমন কঠিন বন্ধ হয়ে যাওয়া দিগন্ত টিভির কর্মীদের অন্য কোনো টেলিভিশনে চাকরি পাওয়া।দিগন্ত টিভি বন্ধ হওয়ার পর অনেকে এখনও চাকরি পাননি বলে শোনা যায়। ফলে তাদের সংসার কী করে চলছে, তা আমরা জানি না। রাষ্ট্রও সেই খবর রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। যেমন প্রয়োজনবোধ করবে না সকালের খবরের চাকরিচ্যুত কর্মীদের সংসার কী করে চলবে, সেই খবর রাখার। নিশ্চয়ই এই কর্মীদের মধ্যে কারো স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। কারো সন্তান হয়তো পৃথিবীতে আসবে এ মাসেই। এসে সে দেখবে তার বাবা একজন বেকার সাংবাদিক। এসে দেখবে তার জন্য পৃথিবীটা বাসযোগ্য করার যোগ্যতা তার অভিভাবকের নেই। অথচ তিনি সাংবাদিকতার মতো একটি ‘মহান’ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

২০০৭ সালে দৈনিক যায়যায়দিনের শতাধিক কর্মীকে একসঙ্গে ছাঁটাই করা হয়েছিল। ঈদের ছুটি শেষে অফিসে এসে দেখছিলাম অফিসের সামনে চাকরিচ্যুত কর্মীদের তালিকা টানানো। সেই তালিকায় নিজের নাম না দেখে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই যখন ভাবলাম, যাদের সাথে একসঙ্গে এতদিন কাজ করলাম পাশাপাশি চেয়ারে বসে, যাদের সঙ্গে ফুটপাথে মাসুদের দোকানে চা খেতাম, আড্ডা দিতাম, সেই মানুষগুলো এখন থেকে আর আমার সহকর্মী নন; বরং তারা এখন বেকার; যাদের মধ্যে অনেকেই (বস্তুত অধিকাংশই) বেতন পাওয়ার পরে ঘর ভাড়া দিতেন––সেই মানুষগুলো আগামী মাস থেকে কী করে চলবেন, এটি ভাবতে একটা শীতল অনুভূতি যেন রক্তের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।

যায়যায়দিনের শুরুর দিনগুলোয় যার তত্ত্বাবধানে কাজ করতাম, এখন একটি টেলিভিশনের সিনিয়র পদে কর্মরত, সম্প্রতি জানালেন তিনি একটা নতুন সংবাদপত্রে যোগ দেয়ার কথা ভাবছেন। তাকে অনুরোধ করলাম জেনেশুনে এমন বিপদের দিকে পা না বাড়াতে। কারণ দেশের শীর্ষ কয়েকটি সংবাদপত্র বাদে বাকিদের যে দুরবস্থা, তা এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলেই জানেন। সুতরাং ‘আপনি এখন একটা টেলিভিশনে ভালো অবস্থানে আছেন, নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন, সুতরাং এটা ছেড়ে একটা অনিশ্চিত গন্তব্যে কেন হাঁটবেন?’ আমার সেই অনুরোধ তিনি রাখবেন কি না জানি না।

অগ্রজ সাংবাদিক, একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের দাম চড়া। গণমাধ্যমে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার। এর মধ্যেই খবর এলো দৈনিক সকালের খবর বন্ধ হয়ে গেছে। এক মহা সংকটের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। এর অর্থব্যবস্থায় কোনো আশার আলোই দেখা যাচ্ছে না। গণমাধ্যম সমাজকে পথ দেখায়। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার নিজের পথই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।’

চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান লিখেছেন, ‘যেদিন ৫৮ বছরে পদার্পণ করলো চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী, সেদিন বন্ধ হয়ে গেলো ঢাকার দৈনিক সকালের খবর। অনেক বন্ধু এবং ছোট ও বড় ভাইবোন বেকার হয়ে পড়লেন। এ মৌসুমী গণমাধ্যম মালিকদের হাত থেকে রক্ষার উপায় কী? অন্য ব্যবসার স্বার্থে গণমাধ্যমে বিনিয়োগ না করে গণমাধ্যম থেকে বিনিয়োগ তুলে আনার মতো,আজাদীর মতো সৃজনশীল ও দূরদর্শী আরো বিনিয়োগকারী এদেশে কবে আসবে!’

গত বছরের ২৬ মার্চ বিবিসি অনলাইনের একটি খবরের শিরোনাম ছিল,‘কাগজে আর ছাপা হবে না দি ইনডিপেনডেন্ট’। সেখানে বলা হয়, ‘ব্রিটেনে ৩০ বছরের পুরোনো একটি সংবাদপত্র দি ইনডিপেনডেন্ট আজ তার সবশেষ প্রিন্ট সংস্করণ বাজারে ছেড়েছে। এখন থেকে এই পত্রিকা শুধু অনলাইনেই প্রকাশিত হবে।’ এটিই ব্রিটেনে মূলধারার প্রথম কোনো পত্রিকা, যারা নিজেদের মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা থেকে অনলাইনে রূপান্তর ঘটায়।

এই সংবাদটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্রের জন্য যে বার্তাটি দিয়েছে তা হলো, মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। হয়তো বছর দশেক পরে কিংবা তারও আগেই পয়সা দিয়ে কাগজে ছাপা পত্রিকা আর কেউ কিনবে না। তবে সকালের খবর কিংবা যমুনা নিউজ বন্ধ হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই আরও একাধিক কারণ রয়েছে।

সকালের খবর বন্ধ হওয়ার বিষয়ে দেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়েছে, ‘১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাংগস গ্রুপের মালিকানাধীন সকালের খবর পত্রিকাটি বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। পত্রিকাটির সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) কমলেশ রায় জানান, আপাতত পত্রিকাটির প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ থাকবে। তবে অনলাইন চালু থাকবে। সম্পাদক আরও বলেন, ওয়েজ বোর্ডের নিয়ম-কানুন মেনে সংবাদকর্মীদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেয়া হবে।’ প্রসঙ্গত, শুধু অনলাইন চালু রাখার কথা বলা হলেও এখানে লোকবল লাগবে খুবই সামান্য। সুতরাং অধিকাংশ সংবাদকর্মীই যে চাকরি হারালেন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর খবরে বলা হচ্ছে, ‘পত্রিকাটি লাভের মুখ দেখেনি। ভর্তুকি দিয়ে এটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছিল। এমনকি কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রটির সব কর্মী রেখে শুধু মালিকানা বিক্রির কথাও ভেবেছিল। সেদিকেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সে কারণেই পত্রিকাটি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’

এ কথা অস্বীকার করার কি কোনো সুযোগ আছে যে, অধিকাংশ মালিকই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দেন তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষার জন্য? গাড়িতে প্রেসের স্টিকার লাগিয়ে রাস্তায় সুবিধা পাওয়ার জন্য? সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের কাছে তদবির সহজ করার জন্য? কিন্তু এতেও দোষের কিছু নেই। কেননা একজন মালিক কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেখান থেকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতেই চাইবেন, নিজের চেহারাটাও সময়-সুযোগ মতো দেখাতে চাইবেন, এটি অস্বাভাবিক বা অন্যায় নয়। বরং এর বিনিময়ে কিছু লোকের যে কর্মসংস্থান হলো, লক্ষ লক্ষ পরিবারের মুখে যে হাসি ফুটলো, সেটি অনেক বড় ব্যাপার। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও এর একটি বিরাট অবদান রয়েছে।

কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তা হলো, আমাদের অধিকাংশ গণপ্রতিষ্ঠানেই কোনো পেশাদারিত্বের চর্চা হয় না। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের অধিকাংশই নিজেদের চাকরি বাঁচিয়ে চলেন। প্রতিষ্ঠানটিকে লাভবান করার জন্য যে ধরনের নিরপেক্ষতা আর পেশাদারিত্বের চর্চা করা দরকার, সেটি তারা নিজেরা যেমন করেন না তেমনি মালিকপক্ষও হয়তো সেটি চায় না।

দ্বিতীয়ত এখন সংবাদপত্রের লাভজনক হওয়া বেশ কঠিন। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিক্রি কমে গেছে। আবার বিজ্ঞাপনের বাজারও সীমিত। হাতেগোণা কয়েকটি সংবাদপত্র বাদে বাকিরা কাঙ্ক্ষিত বিজ্ঞাপন পায় না। বিজ্ঞাপনের বিল আটকে থাকে বছরের পর বছর। মালিক বেশিদিন ভর্তুকিও দিতে চায় না। সব মিলিয়ে সংবাদপত্রের টিকে থাকা বেশ কঠিন।

তৃতীয়ত, অধিকাংশ মালিকেরই ধান্দা থাকে তার মালিকানাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে তিনি তার অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই হয়। ফলে তিনি তার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হোক বা এটি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকুক, সেটি হয়তো চান না।

সাংবাদিকতা পেশার একটি বড় সংকট হলো, এখানে বয়স যত বাড়ে তার চাকরির সুযোগ তত সংকুচিত হতে থাকে। কেননা অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে তার পদবী ও বেতন বাড়ে। কিন্তু মালিকরা চায় কম পয়সায় লোক নিতে। ফলে গণমাধ্যমের শীর্ষ পদে থাকা সাংবাদিকরাও নিজেদের অধিকার আদায়ে মালিকদের সাথে খুব বেশি বাহাসে যেতে চান না। কারণ বেশি বাহাস করলে চাকরিটা চলে যেতে পারে। তখন ওই পদ ও বেতনে আরেকটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া কঠিন। ফলে মালিকের কথার বাইরে তারা খুব বেশি যেতে চান না।

এসব কারণে বারবারই গণমাধ্যমের মালিকানা কার হাতে থাকবে––তা একটি বড় অ্যাকাডেমিক তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সাংবাদিকরাই যখন গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের মালিক হবেন, তখন তারা নিজেদের স্বার্থেই সেটিকে পেশাদার করে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। সেখানে মালিকের আর দশটা এজেন্ডা বাস্তবায়নের তাড়া থাকবে না। আবার এও ঠিক যে, অনেক গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের কারণেই দাঁড়ায় না, অর্থাৎ পেশাদার হয়ে ওঠে না। অনেক প্রতিষ্ঠানে থাকে মাথাভারি প্রশাসন। অনেক অযোগ্য লোক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বসে থাকেন যারা কেবল নিজের চাকরি বাঁচানোয় ত্রস্ত থাকেন। আখেরে তিনি প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে পারেন না, নিজেকে তো নয়ই। এসব মিলিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। ফলে সকালের খবরের যে বন্ধুরা বেকার হয়ে গেলেন, তারা দ্রুতই অন্য কোথায় চাকরি পাবেন, এই প্রার্থনা এবং তাদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ ছাড়া আমাদের আপাতত কিছু করার নেই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)