বিগত সংসদ নির্বাচনে অনেক ভুল মানুষকে এমপি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। দল, দেশ, রাজনীতি ও গণমানুষের ঊর্ধ্বে যাদের ভাবনার বিষয় নিজের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও অর্থ বিত্ত অর্জনের মজবুত ভিত্তি স্থাপন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে তৎকালীন বিরোধী দলীয় সংসদ নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স কর্পোরাল মাহবুবুর রহমান শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ছিলেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর নিজের শরীরকে ঢাল বানিয়ে শেখ হাসিনাকে মঞ্চ থেকে বুলেট প্রুফ গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার ও গুলির আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মাহবুব।
তার স্ত্রী শামীমা আক্তার আসমা দুই ছেলে আশিকুজ্জামান আশিক ও আশরাফুজ্জামান আনাসকে নিয়ে মোহাম্মদ পুরের একটি ৬ তলা ভবনের দুই রুমের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। মাহবুবের গ্রামের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়া জেলায়। তাদের ফ্ল্যাট ভাড়া পরিশোধ করেন আসমার ভাই।
সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে এবার আসমা বলেন, ‘আমার ছবি তুলতে ইচ্ছে করে না, কথা বলতেও খারাপ লাগে। একুশে আগস্ট এলে আপনারা আসেন তাই একটু কথা বলি। আজ মাহবুবের জন্য নেত্রী (হাসিনা) বেঁচে আছেন। নেত্রীর জন্য আজ কতজন এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন সবাই যদি একবার করেও খোঁজ নেন তাহলেতো আমার ছেলেরা অনেক ভাল থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কেউতো খোঁজ নেয় না। প্রধানমন্ত্রীকে যেন আল্লাহ বাঁচায়ে রাখেন। তিনি যদি চলে যান আমাদের কষ্ট হবে, অনেক কষ্ট হবে। আমার একটা মাথাগুঁজার জায়গা নেই, আমার খুব কষ্ট।’
আসমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল দেশব্যাপী একুশে আগস্টে আহত, নিহত পরিবারগুলোর উপেক্ষিত মানবেতর জীবন। আহত, নিহতরা কোন না কোন সংসদীয় এলাকার। সবাই যদি নিজ নিজ এলাকার এইসব পরিবারের খবর নিতেন তাদের কষ্ট, যন্ত্রণা অনেকাংশে লাঘব হত।
কিন্তু কার দায় পড়েছে? এমপিরা ব্যস্ত তাদের কিছু পোষ্য চাটুকার, টেন্ডারবাজ ও নিয়োগবাজ সহযোগীদের নিয়ে। বাস্তবে আরও দেখা যায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের হামলার সময় এই হামলার সমর্থনকারী অনেক হোমরাচোমরা বিএনপি-জামাতের নেতাও আওয়ামী লীগে ঢুকে এমপি হয়ে গেছে। এরকম ভুল মানুষকে মনোনয়ন দেয়াতেই সর্ষেতে ভূতের দেখা মিলছে। দিনে দিনে এই ভূতদের পাল্লা ভারীই হচ্ছে। হয়তো এমন দিন আসছে যে ভূতদের প্রভু ভেবেই বাঁচতে হবে সকলকে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একসময়ের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন। বারবার সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েও তিনি পাননি। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আশির্বাদ পুষ্ট হয়ে তার এলাকা নিকলি-বাজিত পুরে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান বিশিষ্ট জুতা ব্যবসায়ী আফজল হোসেন।
অজয় কর খোকন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নির্বাচনে যেতে পারলেন না। জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে বিপক্ষীয় রাজনৈতিক শক্তি কৌশলে ও ক্ষমতার জোরে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে তার মনোনয়ন বাতিল করিয়ে নিল। ফলে এখানে জনগণ হারালো তাদের ভোট দেয়ার অধিকার। আফজল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বিনা খরচে আবারও সাংসদ হয়ে গেলেন। নিকলি-বাজিতপুরের সাধারণ মানুষ বলাবলি করে যে অজয় কর খোকন স্বতন্ত্র হিসাবেও যদি নির্বাচন করতেন তবে পাশ করতেন।
ছোটবেলা হতেই পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত দেখেছেন মাদারীপুরের শিবচরের মেয়ে সোনালী। পুরো নাম লুৎফুন্নেছা। ঢাকায় পড়তে গিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তিতে ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত হন সোনালী। গ্রেনেড হামলার ২৭ দিন পরে সোনালীর জ্ঞান ফেরে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি। প্রায়ই হাত পা ফুলে যায়।
কিভাবে দিন চলছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, আমার স্বামী একটি বেসরকারি ফোন কোম্পানীতে চাকরি করতেন। অর্থকষ্ট ছিল না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় ভাসুর মারা গেলে আমার স্বামী স্ট্রোক করেন। দুই বছর ধরে খুব যন্ত্রণায় আছি। আরেকটু ভাল চিকিৎসা করা দরকার, করাতে পারছি না। নেত্রীর তহবিল হতে সবার মতই মাসে তিন হাজার টাকা পাই। দল ক্ষমতায় কিন্তু মাথাগুঁজার কোন ঠাঁই নেই এই শহরে।
আরও জানা যায়, ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান বাচ্চু ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তার বুকে, তলপেট সহ শরীরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য স্প্রিন্টার ঢুকে যায়। শুধু দুই উরুর মাঝখান হতে ৪০০ স্প্রিন্টার বের করা হয়েছে। এখনও ৩৭টি স্প্রিন্টার রয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে চান, কিন্তু অর্থের অভাবে পারছেন না।
সারাদেশে এরকম আরও অনেকেই গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে চরম কষ্টে দিনযাপন করছে। একমাত্র সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তাদের পাশে কেউ নেই। কিন্তু কেন? প্রতিটি সংসদ সদস্যদের উচিত নয় কি তাদের খোঁজ নেয়া ও পাশে দাঁড়ানো? নেত্রী বেঁচে না থাকলে তারা কি এমপি হতে পারতেন? ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারের ভরণপোষণ ও বেঁচে যাওয়া আহতদের চিকিৎসার জন্য সব সাংসদরা মিলে কেন বিশেষ ফান্ড গঠন করছেন না? সব দায় একা শেখ হাসিনার উপর কেন চাপাচ্ছেন?
আমরা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সাহায্য তহবিল নয়; ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত, নিহতদের জন্য সকল সাংসদদের বিশেষ তহবিল চাই। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী যেমন আহত, নিহতদের ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নেন প্রতি সাংসদরাও তার সংসদীয় এলাকার গ্রেনেড হামলার শিকার ব্যক্তি ও পরিবারের খোঁজ-খবর নিবেন এটাই মানবিক কৃতজ্ঞতা ও বিবেক সম্মত। না হয় সাংসদদের এ দুটো বস্তু নেই বললে অত্যুক্তি হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)