চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পুলিশের সংখ্যা নয় বিচক্ষণতা জরুরি

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশকে বহুমুখী কাজ করতে হয়। দিন দিন অপরাধীর সংখ্যা, অপরাধের মাত্রা ও প্রকৃতির কারণে কৌশলগত দিক বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মোকাবেলা করতে হচ্ছে পুলিশকে। সাধারণত পুলিশেরা পেট্রোলিং, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, তদন্ত, অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করা; ভিক্টিমকে সাপোর্ট দেওয়া; বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং, রিফর্ম প্রোগ্রাম, জঙ্গী দমনের জন্য বিশেষ টিমের দায়িত্বপালন, রাষ্ট্রের বিশেষ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান, পুলিশিং ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালন অথবা কোন সফল অপারেশনের পর সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করে থাকে।

টিভি নাটক সিনেমায় পুলিশকে সচরাচর হিরো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যারা দেশের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেওয়ার দীপ্ত শপথে বলীয়ান থাকে। বাস্তবে কি আসলেই তেমনটা হয়! প্রায়শই সংবাদ মাধ্যমে পুলিশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। কিছুদিন পূর্বে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বগুড়া শহরে পুলিশ সদস্যদের বাড়ি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়; কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধ পন্থায় বাড়ি নির্মাণ করেছে পুলিশ সদস্যরা। প্রতিবেদনে চিহ্নিত পুলিশ সদস্যরা একটিবারের জন্যও চিন্তা করেনি, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন হয় এবং জনগণকে সেবা প্রদানই তাদের চাকরির মূল ব্রত হওয়া উচিত।

আনুপাতিক হারে হিসেব কষলে জানা যায়, প্রায় ১২০০ জন লোকের জন্য ১ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে হিসাবটা আরো কমে যাবে, কারণ বাংলাদেশের পুলিশ সার্ভিস অরিয়েন্টেড না হয়ে সিকিউরিটি অরিয়েন্টেড। দেশের প্রভাবশালী এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক সিকিউরিটির কাজটা করতে হয় পুলিশ সদস্যদের। তাই অনেকে বলে থাকেন, পুলিশে আরো বেশি সদস্য নিয়োগ দেওয়া দরকার। কিন্তু বেশি সদস্য নিয়োগ দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? আরো বেশি সদস্য নিয়োগ দিলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা নতুন সদস্যদের পিছনে ব্যয় হবে। কিন্তু তা যদি অন্য সেক্টরে ব্যয় করা হয়, তাহলে হয়তবা নতুন একটি সেল ভালভাবে কাজ করতে পারবে যা দেশের জন্য সহায়ক হতে পারে।

ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের (কানাডা) গবেষণা থেকে জানা যায়; পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি অপরাধ কমাতে ভুমিকা রাখে না। কিন্তু যখন অপরাধের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যায় তখন সাধারণরা পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বলে থাকেন।

রাজনীতিবিদেরা নির্বাচনের পূর্বে জনগণের দাবির প্রতি সম্মতি জানিয়ে পুলিশ সদস্য নিয়োগ করে থাকেন নির্বাচনে ভোট পাবার আশায়। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই বাস্তবসম্মত। একটি মাত্র অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরাধের সংখ্যা কমার সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে অপরাধ কমার তেমন সম্পর্ক নেই। তাই নজর দিতে হবে বিচক্ষণতায়, কৌশল এবং দক্ষতায় পুলিশ সদস্যের আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে পুলিশকে কিভাবে বিচক্ষণতায় উন্নত করা যায়। বাংলাদেশের পুলিশের ভূমিকা মূলত প্রোঅ্যাকটিভ, এই ভূমিকাটাকে রিঅ্যাকটিভে নিয়ে আসতে হবে। অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই পুলিশের গোচরীভূত হলে অপরাধী অপরাধ করার সাহস দেখাবে না। প্রবলেম ওরিয়েন্টেড পুলিশিং বাস্তবায়নের মাধ্যমে অপরাধের মাত্রা ও হার উভয়টাই কমিয়ে আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়; নিউইয়র্ক শহরে অপরাধ হ্রাসের ক্ষেত্রে পুলিশ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। আবার লন্ডন শহরের পুলিশের সংখ্যা নিউইয়র্কের তুলনায় কম থাকা সত্ত্বেও অপরাধ কম হয়েছে উল্লিখিত শহরের তুলনায়। সুতরাং সংখ্যা নয় বিচক্ষণতাটা জরুরি। পাশাপাশি জিরো টলারেন্স পুলিশিং বাস্তবায়ন করা অবশ্য কর্তব্য যেখানে সামান্য ক্ষুদ্র অপরাধকে ছাড় দেওয়া হয় না। আমরা দেখি বিশেষ ক্রান্তিকালিন সময়ে পুলিশ প্রধান জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সর্বক্ষণ জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা জরুরি। কেননা, মানুষ সুযোগ পেলেই অপরাধকে সংঘটনের চেষ্টা করে থাকেন, তাই অপরাধের সুযোগের পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে।

পুলিশের বিচক্ষণতাকে কাজে লাগানোর জন্য সরকার তথা রাষ্ট্রকে আরো সাহসী এবং উদ্যমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। প্রতিটা পর্যায়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে সরকার ও জনগণকে। পুলিশিং ব্যবস্থার আধুনিকীরণ; অর্থনীতির উন্নয়ন, মাদকমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিষয়গুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় করতে হবে। কিশোর ও যুবকদের পড়াশোনার প্রতি আরো মনোযোগের জন্য পরিবারকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধ সংঘটনের জন্য যে রিস্ক ফ্যাক্টর আছে সেগুলোর মুলোৎপাটনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। তবেই সহনশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হবে এবং অপরাধকে কৌশলগত উপায়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানী কারমেন উল্লেখ করেন; কিছু নিয়ামকের যথাযথ ব্যবহার করতে পারলে অপরাধ দমিয়ে রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে পুলিশের কাজটা সহজতর হয়। প্রথমত: হাইস্কুল পাশ করা যারা গ্র্যাজুয়েট করতে চায় তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া; দ্বিতীয়ত: পরিশ্রমী ইমিগ্রান্টদের সরকারি কাজে লাগিয়ে দেওয়া’ তৃতীয়ত: পাবলিক প্লেসে নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি পান করা নিষিদ্ধ করতে হবে, চতুর্থত: অপরাধীদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া যাতে সে অপরাধ সংঘটনের সুযোগ না পায়। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করালে পুলিশের কাজটি সহজ হয়ে যাবে অপরাধ দমনে।

অংশীদারিত্ব পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করতে পারলে অপরাধ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এটি বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমন্বয়ের মাধ্যমে চালু করা যেতে পারে। পল ইভান অংশীদারিত্ব পুলিশিং এর প্রয়োগ ঘটিয়ে ইয়ুথ মার্ডার কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন নিউইয়র্ক শহরে। এজন্য মূলত স্কুল ড্রপআউট কমাতে হবে, বেকারদের চাকুরির প্রশিক্ষণ দিতে হবে যার ফলে মূলত ভায়োলেন্স কমে যায়। সরকারি বাজেটে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক বছর পুলিশের জন্য ফান্ডিং বাড়ানো হচ্ছে, আর এ টাকা যাচ্ছে সাধারণ জনগণের পকেট থেকে। কিন্তু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই কি পুলিশিং এর গুণগত পরিবর্তন এসেছে; থানায় সাধারণ মানুষ অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অপরাধের মাত্রা ও হার উভয়েই উধর্বমুখী। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়; ২০১০ সালে অভিযোগকৃত মামলার সংখ্যা ১৬২৮৯৮। ২০১১ সালে মামলার সংখ্যা ১৬২৮৯৮। ২০১২ সালে মামলার সংখ্যা ১৬২৮৯৮। ২০১৩ সালে মামলার সংখ্যা ১৬২৮৯৮। ২০১৪ সালে মামলার সংখ্যা ১৮৩৭২৯ টি। তাহলে কি দেখা গেলো, মামলার সংখ্যা কমছে না বরঞ্চ উর্ধ্বমুখী।

আবার আপনি হিসেব কষলে দেখবেন পুলিশের সংখ্যা এবং বাজেটও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাহলে ফলাফল তো পজিটিভ আসলো না। সেক্ষেত্রে বলা চলে সংখ্যাবৃদ্ধি ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না বরঞ্চ বিচক্ষণতা এবং সুকৌশলী আচরণ পুলিশের অপরাধ দমনে ঈর্ষণীয় ফলাফল বয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে।

বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রতিষ্ঠার পর হতেই বিশেষ বিশেষ অভিযানে সফলতা দেখিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের বাহবা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে যা পুলিশ বাহিনীর জন্য ইতিবাচক। সরকারের কাছে নিবেদন বহাল সদস্যদের প্রশিক্ষিত করে আধুনিক পুলিশিং এবং বিচক্ষণতায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সাবলীল করে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করা উচিত।

বিখ্যাত অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরভিন ওয়ালারের ‘লেস ল মোর অর্ডার’ শীর্ষক বইয়ের ‘পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো নয় চাই অধিক বিচক্ষণ পুলিশ’ অধ্যায়ের শেষ প্যারার বাংলা মর্মার্থ এমন: পুলিশকে অপরাধের ঝুঁকিগুলো খুঁজে বের করার মতোই বিচক্ষণ হতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে পরিকল্পনা করে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং বিভিন্ন কমিউনিটি এজেন্সি বিশেষ করে কিশোরদের সাথে সমন্বয় করে অপরাধ হ্রাসের কৌশল নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ সরকার পুলিশ সদস্যদের বিচক্ষণ হিসেবে তৈরি করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা রাখছি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)