চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রোহিঙ্গাদের কাছে আশ্রয়ের অপর নাম শেখ হাসিনা

জ্যোৎস্না রাত। শান্ত নাফের জলে নৌকা এগিয়ে চলছে। বশিরের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছি। রোহিঙ্গাদের এ বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক না, তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে! মিয়ানমার সরকার মূলত এ যুক্তিতেই রোহিঙ্গাদের তাড়াতে ব্যস্ত। তবে ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইতিহাস ঘেটে আমরা যে তথ্য পাই তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে রোহিঙ্গারা মিয়ানামারের নাগরিক। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য।

১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন। আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায লেখা থাকতো কালেমা। আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোযাং>রোযাইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে। ১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন।

গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী।

এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে। ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব  পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।

রোহিঙ্গারা বলে আসছেন তারা পশ্চিম মিয়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছেন। তাদের বংশধররা প্রাক উপনিবেশিক ও উপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়া পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে মিয়ানমারের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পূর্বে যদিও মায়ানমার রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করত। কিন্তু হঠাৎই মিয়ানমারের সরকারি মনোভাব বদলে যায এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের অফিসিয়াল মন্তব্য হলো তারা জাতীয় জনগোষ্ঠী নয় বরং তারা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী।

মিয়ানমারের সরকার তখন থেকে “রোহিঙ্গা” শব্দটি ব্যবহার বন্ধ করে তাদের বাঙালি বলে সম্বোধন করে। রোহিঙ্গাদের অধিকার আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠন বিশেষ করে আরাকান রোহিঙ্গা জাতীয় সংস্থা তাদেরকে মিয়ানমারের মধ্যে জাতিসত্ত্বার পরিচয় দেয়ার দাবি করে আসছে। ২০১৫ সালের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালের সেনাবাহিনীর অভিযানের পূর্বে মায়ানমারে ১.১ থেকে ১.৩ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাস করতো। তবে এ ইতিহাসের অনেকটাই জানেন না রোহিঙ্গারা। তারা শুধু জানেন তাদের কয়েক পুরুষের বসতবাড়ি সেখানে।

বাপ-দাদা-পরদাদারও আগের সময় থেকে তারা বাস করছেন রাখাইনে। তারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। এর বাইরে তারা কিছু চিন্তা করতে চান না। যদিও তাদের এ চিন্তার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের চিন্তার রয়েছে বিস্তর ফারাক। জ্ঞান এবং রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে নৌকা পৌঁছায় ঘাটে। বশিরদের ধন্যবাদ দিয়ে আমরা ফিরে যাই হোটেলে।রোহিঙ্গাপরদিন সকালে আমরা যাই উখিয়ায়। উখিয়ার একটি হোটেলেই দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ৫০ টাকার মাসের তরকারির দাম তখন ১২০ টাকা। আর গরুর মাংসের দাম একেবারে আকাশচুম্বি। ৩-৪ টি ছোট ছোট টুকরোর গরুর মাংসের ছোট এক বাটি তরকারির দাম ১৫০ টাকা। সবজি-চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর দামও বেড়ে গেছে রাতারাতি। এ যেন রীতিমত ঈদের বাজারে পরিণত হয়েছে উখিয়া এবং টেকনাফের দোকানগুলো। উখিয়ার রাস্তায় তখন কেবল মানুষ আর মানুষ।

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা তখন যে যার মত থাকার জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। কেউবা পাহাড়ের ঢালে, কেউবা স্কুল-মাদ্রাসার বারান্দায়, কেউবা মার্কেটের ছাদে। ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। নারী পাচারকারীরা অনেক রোহিঙ্গা নারীদের কক্সাবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে বাইরে নিয়ে পাচার করে দিচ্ছে এ খবরও শোনা যাচ্ছে বেশ। যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে একরাত আগেই অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের জন্য সময়টা ছিলো বেশ কঠিন। পেছনে ফেলে আসা মৃত্যুকে তারা ভুলতে চায়। দুঃসহ স্মৃতি তখন তাদের ক্লান্ত চোখেমুখে। নতুন এ দেশে বাচাঁর আশ্রয়ে তারা ঘুরছে।

তবে কেউই জানে না কোথায় যাবে। হাটঁছে তো হাঁটছেই! কোথায় গিয়ে শেষ হবে এ হাটা! কোথায় গিয়ে মিলবে একটু আশ্রয়, একটু খাবার? তাও অনিশ্চিত। রাস্তায় যত্রতত্র ত্রাণ মিললেও কারো ভাগ্যে মিলছে একাধিক প্যাকেট আবার কেউ পাচ্ছে না কিছুই। ত্রাণ প্রত্যাশীদের সঙ্গে আবার যোগ দিয়েছে স্থানীয় অনেক বাঙালি। এ নিয়ে একটি মজার ঘটনার কথা বলি। একদিন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কিভাবে একজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে জীবনযাপন করছে তার পুরোটা নিয়ে রিপোর্ট করবো। উখিয়ার বালুখালীর একটি রাস্তায় একজন রোহিঙ্গা মাকে ৩ সন্তান নিয়ে ত্রাণের অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখলাম।

সারাদিন বসে থেকে সে ২টি ৫ কেজির চালের প্যাকেট, কিছু শুকনা খাবার ও ২ হাজার টাকার মত অর্থ সাহায্য পেয়েছে। সে জানালো তার স্বামীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। কোনমতে বাচ্চাদের নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। পাশেই একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠাঁই হয়েছে। তার কথায় মায়া হয় আমাদেরও। পেশাদারিত্বের বাইরে আমরাও মানুষ, ভাবছি তখন। পকেট থেকে আমিও ৫শ’ টাকার একটা নোট তাকে দিলাম। টাকা পেয়ে ওই রোহিঙ্গা নারীর মুখের হাসি দেখে আমিও মনে কিছুটা শান্তি পেলাম। তবে বিপত্তি ঘটলো এর কিছুক্ষণ পরেই।

আমরা তার থাকার জায়গা দেখতে চাইলে বিপত্তি ঘটে। আমাদের সঙ্গে একটু দূরে গিয়ে দৌড় দেয় সে। পিছুপিছু গিয়ে আমরা জানতে পারি ওই নারী স্থানীয় বাঙালি। এ ঘটনায় অনেকক্ষণ হেসেছি। আবার এও চিন্তা করেছি, আমাদের দেশেও কত দরিদ্র মানুষ সবখানে। রোহিঙ্গা সেজে যেসব বাঙালি ত্রাণের আশায় বসেছে তারাও কতটা অসহায়! এ ঘটনায় একটা বিষয় মাথায় আসলো যে ত্রাণ সঠিক জায়গায় যাচ্ছে না। অর্থাৎ তখন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ পুরনো রোহিঙ্গা এবং কিছু বাঙালি নিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই ত্রাণ পাচ্ছে না। তখনই সিদ্ধান্তটা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। যত্রতত্র রোহিঙ্গারা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের সাথেই ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের জন্য। এর ফলে ত্রাণ বিতরণেও শৃঙ্খলা ফিরবে এমনটাও ধারণা করা হয়।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে উখিয়া এবং টেকনাফের ১২টি পয়েন্ট নির্দিষ্ট করা হয় ত্রাণ বিতরণের জন্য। এর আগের ক’দিন রোহিঙ্গারা কেবলমাত্র রাতের বেলা ঢুকলেও এবার দিনের বেলাতেই শুরু হয় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টেকনাফ এবং উখিয়ার বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের একত্র করতে কাজ শুরু করে বিজিবি। ট্রাকে করে রোহিঙ্গাদের উখিয়ায় নিতে শুরু হয় তখন থেকেই। নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার সিদ্ধান্ত হলেও যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে তাদের যখন ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটা জানা গুরুত্বপূর্ণ হবে। এ ধারণা থেকে তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের।মানবিকতার পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থানকে স্বাগত জানায় পুরো বিশ্ব। রোহিঙ্গাদের চোখেও তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতাময়ী এক মায়ের নাম। এক রোহিঙ্গা নারীতো তার সদ্যজাত কন্যাসন্তানের নামই রেখে দেন শেখ হাসিনা! যা নিয়ে পরবর্তীকালে বিশ্বগণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হয়।

নিজ দেশের শান্তিতে নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সুচির নিষ্ঠুরতা তারা দেখেছে। নোবেল পুরস্কার কী তারা জানেন না, হয়ত তারা জানতে চাইবেও না কখনও। তবে মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসা এ রোহিঙ্গাদের যে নেত্রী কোলে তুলে নিয়েছেন, দিয়েছেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন, সেই নেত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই তখন রোহিঙ্গাদের কাছে শান্তির অপর নাম।

(চলবে)