জাতিসংঘের বিভিন্ন জরিপে জানানো হয়, সারা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি শিশু যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদীদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে চলছে। এসব শিশু গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এদের একটি বড় অংশ অন্য আরেকটি দেশে বসবাস করছে। এরা নিজ আবাস ভূমি ছেড়ে অন্যত্র বাস করতে বাধ্য হয়েছে। যার মূল কারণ হলো যুদ্ধ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বিরূপ শিকার হচ্ছে আরও অসংখ্য শিশু। পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের প্রায় ৮৭টি দেশের শিশুরা বসবাস করছে ৬ কোটি স্থল মাইনের বিস্ফোরণের ঝুঁকির মধ্যে। প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার শিশু শিকার হচ্ছে এসব স্থল মাইনের। ৩ লাখ মেয়ে যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে,তাদের জোর করে শিশু সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বয়স একটু বাড়লেই তাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে পতিতালয়ে।
ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের ভবিষ্যত প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানে প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৭৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে আলোচনার পরিণতিতে সম্পাদিত হয় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি। আরব লীগ এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। পি এল ওর অংশগ্রহণ ছাড়াই একতরফা এই চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং এতে ফিলিস্তিন জনগনের অধিকার বিবেচনা করা হয়নি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদও এই চুক্তির নিন্দা করে। ১৯৭৮ সালে লেবাননের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার বিরুদ্ধে ইসরাইলী বাহিনীর সামরিক হামলা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ ইসরাইলের প্রতি আহবান জানায়। ইসরাইলী বাহিনীর প্রত্যাহার নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় লেবাননের সরকারের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদ লেবাননে অন্তর্বতীকালীন জাতিসংঘ বাহিনী গঠন করে।
১৯৮২ সালের মে মাস পর্যন্ত এলাকাটি সাধারণভাবে শান্ত ছিল। এলাকায় জাতিসংঘ যুদ্ধ বিরতি চুক্তি তত্ত্বধায়ক কার্যক্রম, জাতিসংঘ প্রত্যাহার পর্যবেক্ষক বাহিনী ও লেবাননে অর্ন্তবতীকালীন জাতিসংঘ বাহিনী- এ তিনটি শান্তিরক্ষী কার্যক্রম বিদ্যমান থাকে।
১৯৮২ সালের জুনের প্রথম দিকে ইসরাইল-লেবানন সেক্টরের পরিস্থিতি আকস্মিকভাবে বদলে যায় এবং লেবাননে ব্যাপক লড়াই শুরু হয়। ৪ জুন ইসরাইল যুদ্ধ বিমান বৈরুত এলাকার লক্ষ্য সমূহের উপর হামলা চালায়। ৫ জুন নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে এই সামরিক তৎপরতা বন্ধের আহবান জানায়। পি এল ও তাতে সাড়া দেয়। কিন্তু ইসরাইলী বাহিনী বিপুল শক্তি নিয়ে ৬ জুন লেবানন ভূখন্ডের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে।
লেবাননে চলতে থাকে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা ও লেবানন জাতীয় আন্দোলন এর সশস্ত্র যোদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধ। ইসরাইলের অনুপ্রবেশ ও বেপরোয়া আক্রমনে বহু নিরপরাধ ফিলিস্তিন ও লেবানন শিশু নিহত হয়। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯ আগস্ট ১৯৮২ তারিখে ফিলিস্তিন প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় এবং আতংকজনক পরিস্থিতিসহ ইসরাইলী বর্বোরচিত আগ্রাসনের তারিখ ৪ জুন স্মরণে এই দিনকে ঘোষণা আগ্রাসনের শিকার নিরীহ শিশুদের স্মরণে আন্তজাতিক দিবস।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল এক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে যে, যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম হিসেবে গত এক দশকে কমপক্ষে ১০ লাখ শিশু নিহত হয়েছে। আহত বা এতিম শিশুতে পরিণত হয়েছে অগণিত শিশু। রিপোর্টে বলা হয়, যুদ্ধে ২০ লাখেরও বেশী শিশু নিহত হয়েছে, ৬০ লাখ হয়েছে আহত এবং এদের মধ্যে অসংখ্য শিশু একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছে। আরো ১০ লাখ শিশু মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেছে অথবা হয়ে গেছে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন। ২ কোটিরও বেশি শিশু গৃহহারা হয়েছে যুদ্ধের কারণেই।
এছাড়া ১৮ বছরের নিচের বয়সী ৩ লাখ শিশু ৩০ টির বেশী দেশে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তাদের কেউ সৈন্য কেউ বা যুদ্ধের রসদ বহনকারী, দূত বা যৌন কৃতদাসের কাজ করছে। ১৯৪৫ সালের আগে যুদ্ধে বেশীরভাগ শিকার হতো সৈন্যরা। সেই থেকে এই পযন্ত ১৫০টিরও বেশী যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। এ সকল যুদ্ধে কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করেছে এবং আরো ৬০ মিলিয়ন আহত হয়েছে। জাতিসংঘের জরিপ মতে ক্ষতিগ্রস্থদের নূন্যতম ৮০ ভাগই সৈনিক ছিল না।
প্রকৃত পক্ষে তাদের বেশীরভাগই ছিল মহিলা ও শিশু। একদিকে যেমন যুদ্ধে, আগ্রাসনে নিরাপরাধ নিরীহ শিশুর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অন্যদিকে শিশুদের ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধে। জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী ২ লাখেরও বেশী ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুকে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর অধীনে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৫ বছর বয়সের নীচে কেউ যেন যুদ্ধে অংশ্রগ্রহণ না করে তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রগুলোকে আহবান করা হয়েছে। সনদে বলা হয়েছে যুদ্ধের সময় শিশু ও তাদের মায়েদের জন্য বিশেষ রক্ষা ব্যবস্থা ও ত্রাণ সরবরাহের অনুকূল আইনের প্রতি রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ শিশুদের সৈন্য হিসেবে ব্যবহার ও যুদ্ধের সময় তাদের খুন জখম ও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোকে পুনরায় আহবান জানিয়েছে। রণাঙ্গনে শিশুদের রক্ষা এবং সশস্ত্র সংঘাতের সময় যারা ইচ্ছাকৃতভাবে শিশুদের টার্গেট করে তাদের নিন্দা জ্ঞাপন ও শান্তি বিধানের জন্য সব দেশের প্রতি আহবান জানিয়ে একটি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়েছে।
১৯৯৯ সালেও অনুরূপ প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেবারই পরিষদ প্রথম ইস্যুটি তুলে ধরে। এ প্রস্তাবে ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার সনদ উল্লেখ করে এতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো তাদের সশস্ত্র বাহিনীতে ১৮ বছরের কম বয়সী সদস্যদের নৃশংসতায় প্রত্যেক্ষভাবে অংশ না নেয়ার নিশ্চয়তা বিধানে আহবান জানানো হয়।
সিয়েরা লিয়ন থেকে শুরু করে শ্রীলংকা পর্যন্ত বিশেষ করে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৩ লাখ শিশু কাজ করছে। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এক দশকে ২০ লাখ শিশু মারা গেছে। ৬০ লাখ শিশু আহত হয়েছে ও ১০ লাখ শিশু এতিম হয়েছে। যুক্তরাজ্য সেভ দ্য চিলড্রেন জানায় যুদ্ধের ফলে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ শিশু এ্যাংঙ্গোলা ও গণতান্ত্রিক কংঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো নিজ দেশেই সব বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে।
আধুনিক বিশ্বের শিশু পরিস্থিতিও খুব ভালো সেটা বলা যাচ্ছে না। পশ্চিম ইউরোপের অন্তত ২০ হাজার শিশু প্রতি বছর একাই বেড়ে ওঠে। তাদের আশপাশে থাকে না তাদের বাবা কিংবা মা। অভিভাবকহীনতাও শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়ার একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে চলছে। আশা করা হয়, আগ্রাসনের শিকার নিরপরাধ শিশুদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবসকে কেন্দ্র করে সব দেশের সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এগিয়ে আসবে। শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিত পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার এবং যুদ্ধকালীন সময়ে শিশুদের অপব্যবহারের পথ বন্ধ করে দিতে হবে চিরতরে। এজন্য আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। ‘শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচার, শিশুযুদ্ধ বন্ধ করো’, কেবল এসব স্লোগান দিলেই হবে না, এ ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)