চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শিশুদের নাম ভাঙ্গিয়ে বড়রা সুবিধা ভোগ করছে

মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী  আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য।  পর্ব-৬ (ডিসেম্বর ৬, ২০১৬)

গড ফাদার সিনেমার সেই ডায়ালগের কথা মনে আছে? “দি ওনলি ওয়েলথ ইন দিজ ওয়ার্ল্ড ইজ চিলড্রেন, মোর দ্যান অল দি মানি, পাওয়ার অন আর্থ।” সিনেমায় কথাগুলো যখন পরাক্রমশালী মাফিয়া সর্দার মাইকেল করলিওন বলেন, দর্শকদের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে। সেটা বাড়িতে কেউ একা বসে দেখেন কিংবা সিনেমা হলে বা দলে বসে দেখেন। সব দর্শক শিশুদের গুরুত্ব আবারো অনুভব করেন। কিন্তু ছবি শেষ হওয়া মাত্র দর্শক এই কথাগুলো ভুলে যান। তারা ভুলে যান শিশুদের জন্য তাদেরও কিছু করার আছে। আর শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি করার আছে জনগণের পক্ষে সরকারের। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের ইতিহাস শিশুদের বঞ্চনার ইতিহাস। বাংলাদেশের শিশুদের বঞ্চনার ইতিহাসের মূল কারণ শিশুরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। তারা কোন রাজনৈতিক দলের নেতা নয়। আর যেকারণে শিশুদের উপর যেভাবে ফোকাস থাকার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর ফোকাসে শিশুরা সেভাবে নেই। এমনকি শিশুরা কোন ধর্ম কিংবা গোত্রের কাছেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ এমন একজন বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষ পাবেন না যে বা যারা স্বীকার করেন না- শিশুরা আগামীর ভবিষ্যৎ। প্রশ্ন হলো শিশুরাই যদি ভবিষ্যৎ হবে তাহলে তাদের প্রতি আমাদের আলাদা গুরুত্ব নেই কেন? শিশুদের তো সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া দরকার। এবং শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা।

11a9a19c724db30a66cefa0bae2e0c2a

আপনাদের মনে থাকার কথা ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করেছিল। এর সহজ মানে হলো তাদের যে নির্বাচনী ইশতেহার ছিল জনগণ তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এই সমর্থনের ফলে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত সবগুলো অঙ্গীকার পালন করা। নির্বাচনী ইশতেহার ও রূপকল্প ২০২১ হলো বর্তমান সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত নথি, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সংযোজন করেছিল। নির্বাচনী ইশতেহার রূপকল্পে শিশুদের উন্নয়ন বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছিল। ইশতেহারের অনুচ্ছেদ (১৩)-তে শিশুদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: পর্যায়ক্রমে সর্বক্ষেত্রে শিশুশ্রম বন্ধ করা হবে। শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার, প্রলোভন বা জোর করে জড়িত করা হবে না। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী শিশু অধিকার সংরক্ষণ, ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ১৯৯৪ সালের শিশুনীতি পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করা হবে। তাদের শারীরিক, মানসিক বিকাশে পুষ্টি শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। শিশু নির্যাতন বিশেষ করে কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা জানি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে পুনরায় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। যেহেতু ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের কথাগুলো ২০২১ সালের রূপকল্পও সেকারণে আওয়ামী লীগ সুযোগ পেয়েছে তাদের কাজগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার। এছাড়াও শিশু প্রসঙ্গটি ইশতেহারের স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংক্রান্ত রাজনৈতিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষা প্রসঙ্গে ইশতেহারে বলা হয়েছে ২০১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে নিট ভর্তির হার ১০০ শতাংশ, ২০১৭ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়ন, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা হবে।

নির্বাচনী ইশতেহার ছাড়াও সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে তার সরকারের অঙ্গীকারের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে এমডিজি অর্জনের অগ্রগতি প্রসঙ্গে দেয়া বক্তৃতায় “২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধানে সন্তান প্রসব দ্বিগুণ করার (বর্তমানে ২৪.৪ থেকে) অঙ্গীকার করেছেন, কিশোরীদের গর্ভধারণের হার হ্রাস, ২০১৫ সালের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা অর্ধেকে নামিয়ে আনা (বর্তমানের ১৮ শতাংশ থেকে); এবং শিশুর অসুস্থতায় সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে সার্বজনীন করার নিশ্চয়তা প্রদান করেন।” (পরিকল্পনা কমিশন, ২০১০)।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের শিশু অধিকার সপ্তাহ ও বিশ্ব শিশু দিবসের বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, ‘আমরা নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সকল খাত থেকে শিশুশ্রম বিলোপ করব। শিশুদের যাতে কোনভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার না করা হয় সেব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার ঘোষণা অনুযায়ী শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ আমরা নেব।’

তিনি ওই সময়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের ১৯১টি দেশ আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে। এ সনদে যে ২২টি দেশ প্রথম সমর্থন করেছিল বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। আর তাই বাংলাদেশের শিশুদের বিকাশ ও অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এখাতে পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করতে তিনি ও তার দল দেশের জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালের বক্তৃতায়ও তিনি একথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। সেসময়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘২০১৪ সালের মধ্যে আমরা দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করব।’
আওয়ামী লীগ এরপর ২০১৪ সালে পুনরায় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। সবমিলিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের সময়কাল ৮ বছর পার হয়েছে। এখন যদি আমরা দেখি আওয়ামী লীগ সরকার তাদের অঙ্গীকার পূরণে কতটা সাফল্য দেখিয়েছে তাহলে দেখা যায় তাদের সাফল্য মিশ্র। বড় একটা সাফল্য হলো ১৯৭৪ সালের শিশু আইন এবং ১৯৯৪ সালের শিশু নীতি পর্যালোচনা করে ২০১৩ সালে নতুন শিশু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এটা অবশ্যই একটা বড় সাফল্য। কিন্তু আইন বাস্তবায়নের অবস্থা খুবই নাজুক। এছাড়া শিশুদের শারীরিক, মানসিক বিকাশে পুষ্টি শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার ব্যাপারে তেমন কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির অবস্থা মারাত্মক। ৪২ শতাংশ শিশু বয়সের তুলনায় খাটো, ৩২ ভাগ শিশুর ওজন উচ্চতা অনুযায়ী কম। শিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। স্কুলের যাওয়ার বয়সী প্রায় ২৭ ভাগ শিশু স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে। এই সংখ্যাটি না কমে বরং বেড়েছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যাও মাত্র ১ শতাংশ কমেছে। আবার দেরি করে স্কুলে ভর্তি হওয়ার শিশুর সংখ্যা প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও সরকারের সাফল্য নেই বললেই চলে। এখনো ৫ বছরের কম বয়সী প্রতি ৫টি শিশুর মধ্যে মাত্র ২টি শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা হচ্ছে। বাল্য বিবাহের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বর্তমানে বিবাহিত ২০-২৪ বছর বয়সী নারীর মধ্যে ১৮ ভাগের বিয়ে হয়েছে বয়স ১৫ হওয়ার আগে। আর ৫৩ ভাগের বিয়ে হয়েছে বয়স ১৮ হওয়ার আগে। আর নারী বয়স গ্রুপ যদি ২০ থেকে ৪৯ বিবেচনা করা হয় তাহলে ৬২.৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে এবং ২৭ ভাগের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের আগে। অন্যদিকে, শিশু নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা চরম। বখাটের উৎপাতও বিগত বছরগুলোতে বহুগুণে বেড়েছে। সরকারের ব্যর্থতার তালিকা আরো বড় করে তো কোন লাভ নেই। আমাদের বরং সমাধান খোঁজা দরকার।razon1438867688

আর তাই শিশুদের সমস্যা সমাধানে শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা দরকার। কারণ পৃথক মন্ত্রণালয় না থাকায় শিশুদের দায়িত্ব সেভাবে কেউ নিচ্ছে না। সবার কাজের মধ্যেই শিশুদের জন্য কিছু না কিছু করা হচ্ছে। অনেক মন্ত্রণালয় তাদের কাজের মধ্যে শিশুদের কল্যাণের কথাও বলে থাকে। দেশে কয়েক হাজার এনজিও এবং সংগঠন রয়েছে যারা শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিশুদের নিয়ে যতো কথাবার্তা বলা হয়, তার সুফল শিশুরা সেভাবে পায় না। বরং শিশুদের কথা বলে বড়রা দুধের সর খেয়ে যাচ্ছে। তারা বিদেশ যাচ্ছে, গাড়ি হাকাচ্ছে, সভা সেমিনারে বক্তব্য রাখছে। দিনের শেষে শিশুদের জীবনে জুটছে ”ঘোড়ার ডিম”। কারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, জন্ম নিবন্ধন, প্রজনন স্বাস্থ্য, বাল্য বিয়ে কোথাও গর্ব করার মতো কিছু ঘটছে না। বরং শিশু নির্যাতনের খবর প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে। আবার সেই নির্যাতনকারীর শাস্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে না। বখাটেদের উৎপাত এখন শিশুর জীবন ছাড়িয়ে পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে বখাটেদের শিশু নির্যাতন করা যেন তাদের অধিকারের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। শিশুরা রাজনীতির আশ্রয় পাচ্ছে না কিন্তু বখাটেরা পাচ্ছে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এই কারণে ৪৫ বছর আগে স্বাধীন হয়নি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)