কাদেরি কিবরিয়া। বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীশিল্পী। বছরের বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এক সময় তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। অনেক বছর পর আবার সেখানে ফিরে গেলেন। সেই অনুভূতি তিনি লিখেছেন ফেসবুকে—
দীর্ঘ ৪২ বছর পর আমার প্রাণের শান্তিনিকেতন যাত্রা , ভোর রাতে শিয়ালদাহ রেল ষ্টেশনে গিয়ে রেল ধরে স্মৃতি বিজড়িত বোলপুর রেল ষ্টেশন, অতঃপর রিক্সা নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাত্রা। আমার শান্তিনিকেতনে অধ্যায়নকালীন সময়ে একজন রিকশা চালক ছিলেন, ওর নাম ছিল রাজু। সর্বদা ও আমাকে ষ্টেশন থেকে আনা নেওয়া করত। আজ রিকশায় উঠেই রিকশাওয়ালাকে রাজুর কথা জিজ্ঞাস করলাম, ৪২বছর আগের টগবগে যুবক রাজু আজ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে গ্রামের বাড়িতে। তাই দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হলো না ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তিনিকেতনের মূল ফটকে চলে আসলাম, সংগীত ভবন, কলা ভবন নাট্য মঞ্চ, শ্রেণী কক্ষ— একে একে দেখছি আর স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কোথায় যেন বেসুরো মনে হচ্ছে, বার বার ছন্দ পতন হচ্ছে। আমার দেখা ৪২ বছর আগের শান্তিনিকেতনকে আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেই নান্দনিক শৈল্পিক নির্মল ভালবাসায় স্নেহে মাখামাখি শান্তিনিকেতন কোথায় ?
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দ মোহরদি, নীলিমা সেন, বিরেন পালিত, ডিডি জোশীর সেই সময়কার শান্তিনিকেতন আমার কাছে অনুপস্থিত। বার বার স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছি চোখ বুজে দেখার চেষ্টা করছি এই মেঠো পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছাত্রছাত্রীদের চলাচল। আজ এখানে সাইকেলের বিচরণও হাতে গোনা। আমার বন্ধু ও শান্তিনিকেতনের সহপাঠী বরেণ্য রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী পাপিয়া সারওয়ারের সঙ্গে একত্রে অনুশীলন করা, শ্রেণী কক্ষে যাতায়াত— কত স্মৃতি।
কদমতলি হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন সেই হোস্টেল অফিসের অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবলার ওস্তাদজীর বাসা দেখলাম। আজও বাড়িটি ৪২ বছর আগের চিত্র নিয়ে জীর্ণ শীর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রদ্ধেয় শান্তি দেব ঘোষের বাসায় গেলাম।
বন্ধ ফটকে দাড়িয়ে দেখছি এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোক গাছে পানি দিচ্ছেন। তিনি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আমি কে, কী চাই ? আমি জানতে চাইলাম, এটা কি শান্তি দেব ঘোষের বাসা ? উনি উত্তরে বললেন ঠিক তাই।
ফিরে আসলাম স্মৃতিময় বাড়িটির পাশ থেকে। রাস্তা খুঁজে খুঁজে মানুষকে জিজ্ঞেস করে নীলিমা সেনের বাসা খুঁজে বের করলাম। রাস্তার দু’পাশে রঙ্গিন ফুলের ছায়া এখনো আছে। কিন্তু ৪২ বছর আগের তুলনায় অনেক মলিন, নীলিমা সেনের মেয়ের সঙ্গে এতকাল পরে দেখা হলো।
দেখতে পেলাম যে আউট হাউসে এক বছর ছিলাম, সে বাড়িটি আজ শীর্ণ জীর্ণ শরীর নিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। আমি বাসবিদি , মন্দিরাদি ও পাপিয়া সারওয়ার গইঙ্কা, বিড়লা, টাটা নামের এই তিনটি হোস্টেলের সামনে যে মাঠ ছিল সেখানে বসে কত গান আর গল্প করেছি— আজ সেই মাঠেও পূর্বের সেই সৌন্দর্য অনুপস্থিত।
আমার শান্তিনিকেতনের এই স্বল্প সময়ের যাত্রা আমাকে যতটা না সুখাভুতিতে আন্দোলিত করেছে, তার চেয়ে বেশি কষ্টের অনুভুতিতে আচ্ছাদিত করেছে, যেন রবি ঠাকুরের ছোট গল্পের মতো শেষ হইয়াও হইলনা শেষ। কী ছিল, কী যেন নেই!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্ন দিয়ে বোনা শান্তিনিকেতন, আমার যৌবনের তাজা সুবাসের শান্তিনিকেতন, আমার হৃদয়ে থাকুক ৪২ বছর আগের সুঘ্রাণ নিয়ে। রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘আমার যাবার সময় হলো, আমায় কেন রাখিস ধরে, চোখের জলের বাঁধন দিয়ে বাধিস নে আর মায়াডোরে’।