চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

শাকিল সংবাদ: একটি মন খারাপের লেখা

মরে যাওয়া মানুষ তুমি আর কতদূর যাবে?
খাটিয়ার গতি কি ছুঁতে পারে জীবনের গান?
খুব বেশি বিষাদ ছিল তোমার নির্ঘুম চোখে?
পুড়ে যাওয়া সমস্ত শ্লোক মনে করিয়েছিল ভুল কবিতার খাতা?
ভীষণ বাঙ্গময় তুমি আজ নিথর ক্রীতদাস, নিয়তির, যাও
অন্ধকারে, মাটিতে, পড়ো ফেলে আসা জ্যোৎস্নার ইতিহাস।
(অগস্ত্য যাত্রা, মন খারাপের গাড়ি, পৃ: ১৯)

শাকিল ভাইয়ের ২য় কাব্যগ্রন্থ ‘মন খারাপের গাড়ি’ বেরিয়েছিলো ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। আর বইটি আমাকে দিয়েছিলেন মার্চের ৮ তারিখ। সন্ধ্যা বেলায়। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তখন শাকিল ভাইয়ের কানে ছোটখাট একটা অপারেশন হয়েছিলো। বিষয়টা অবশ্য আমার জানা ছিলো না। শাকিল ভাইয়ের ফোন পেয়ে মূলত আড্ডা দিতেই গিয়েছিলাম। ফোন ধরে যখন বললাম ‘কোথায় আসবো’? শাকিল ভাই বললেন ‘অমুক হাসপাতালের অমুক তলায় চলে আসুন’। বেশ হাসিখুশি গলা। দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। তবে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বললাম ‘আমি আর ওবায়েদ আকাশ আসতেছি, শাকিল ভাই। তুমুল আড্ডা হবে।’

লিফট থেকে বের হয়েই দেখি আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন সুদর্শন শাকিল ভাই। মনেই হলো না অপারেশন হয়েছে। কী প্রাণবন্ত, কী হাসিখুশি! আমাদের আর জিজ্ঞেস করা হয় না। আমরা আড্ডায় মেতে উঠি। চিকিৎসক, কবি আব্দুল্লাহ জামিলও যোগ দেন আমাদের সাথে। চাকরি সূত্রে হাসপাতালেই ছিলেন জামিল ভাই। দুই কামরার সেই ফ্ল্যাটে আরো অনেকেই ছিলেন। তবে অন্য কামরায়। আমার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘জয় বাংলা’র পাণ্ডুলিপি সাথে ছিলো। উৎসর্গ পাতাটি দেখে শাকিল ভাই কী যে খুশি হয়েছিলেন! জড়িয়ে ধরলেন। পাণ্ডুলিপি নিয়ে অন্য কামরায় দৌড়ে গেলেন।

নিকটজনদেরকে দেখিয়ে বললেন ‘কবি আমাকে জয় বাংলা উৎসর্গ করেছে।’ ‘জয় বাংলা’ উৎসর্গ করে বড়ো উৎফুল্ল হয়েছিলাম। সেদিন কি আর জানতাম প্রকাশিত বইটি তার হাতে আর তুলে দিতে পারবো না? একটি অপ্রত্যাশিত সংবাদ সেই আনন্দ-স্মৃতিকে কান্নার স্মৃতিতে পরিণত করবে?

শাকিল ভাই সেই সন্ধ্যা-আড্ডায় ‘মন খারাপের গাড়ি’র পাতায় লিখে দিয়েছিলেন ‘তুমুল উদ্বাস্তু কবি মুজিব ইরমকে ভালোবাসা’। ‘কবিবংশ’ ও ‘শ্রীহট্টকীর্তন’ বই দু’টির ডায়াস্পোরা কবিতা পড়ে তার মনে হয়েছিলো আমিও মাহমুদ দারবিশের মতো ‘তুমুল উদ্বাস্তু কবি’। সেই ডায়াস্পোরা হাহাকারগুলো তাকে বড়ো স্পর্শ করেছিলো! সেদিন অনেক ছবি তুলেছিলাম। শাকিল ভাই ব্যান্ডেজ করা কানটি বড়ো কসরত করে আমার মাথার পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যাতে ছবিতে ধরা না-পড়ে। আহা ছবি, বড়ো মন খারাপের ছবি!

২.
অষ্টমী কিংবা বেদনার গান
(মিলন পাঠানকে)
কোনো কোনো মাঝরাতে গান থেমে যায়
মরে যায় পদাবলি, একান্ত অধীশ্বর।
মরে যায় প্রেম, বিরহে বেদনায়, মরে যায়
শৈশব, ঠাকুমার ঝুলি, সাদা হাতি, বিষণ্ণ প্রলাপ।
দিনগত পাপক্ষয়, আমরা কতিপয়, রাতভর ক্রমাগত জাগি
ক্ষুধা জাগে, জাগে না প্রেম, তানপুরা জুড়ে থাকে জাগানিয়া আলাপ।
(মন খারাপের গাড়ি, পৃ: ৬২)

‘কবি মাহবুবুল হক শাকিল স্মারক গ্রন্থে’র জন্য প্রিয়জন মিলন পাঠান লেখা চাইলে মনটা বড়ো বিষণ্ণ হয়ে যায়। সেই অবিশ্বাস্য ‘শাকিল সংবাদ’, সেই সর্বনাশী খবরের রেশ আমাকে জাপটে ধরে। আর আমার মনে পড়ে মিলন পাঠানকে উৎসর্গিত ‘মন খারাপের গাড়ি’র ‘অষ্টমী কিংবা বেদনার গান’। আবারও পড়ি আর বেদনাক্রান্ত হই। সত্যি সত্যি শাকিল ভাই নেই? আমাদের বংশের লোক, কবিবংশের লোক, কবি মাহবুবুল হক শাকিল আর আমাদের মাঝে নেই? এ কী করে সম্ভব? হায়, ‘বংশ কেনো খালি করে কবি চলে যায়’!

আর আমার সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে, সেই আড্ডার কথা মনে পড়ে। মনের ভেতর আহাজারি নামে। আমি ‘মন খারাপের গাড়ি’ বের করে পড়তে থাকি। কী হাহাকার, কী বেদনা একেকটি কবিতার ভিতর লুকিয়ে আছে! উৎসর্গ পত্রটিও কী বেদনাময়, কী কান্নাময়! ‘দগ্ধ সময়কে, যাকে ধরতে চেয়েছিলাম আমারই রক্তে-কষ্টে-কলমে’। উৎসর্গ পত্রটি পড়েই মনটা বড়ো বিষণ্ণ হয়ে ওঠে! একে একে আমি পড়তে থাকি তার প্রেম বিরহ হাহাকার, পড়তে থাকি মৃত্যু, জীবন, শৈশব ও বেদনা। আর এই সব কবিতা, এই সব ঘোর লাগা লাইন, মৃত্যু ও বিচ্ছেদ, আমাকে একটি মন খারাপের লেখা লিখতে প্ররোচনা দেয়। আমি খাতা কলম নিয়ে বসে পড়ি। কবি-পরিচিতির শেষ লাইনে আমার চোখ আটকে থাকে, মন আটকে থাকে।

‘প্রেম, বিরহ এবং কবিতা ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য সঞ্চয় নেই তাঁর’। শাকিল ভাইকে নিয়ে, কবি মাহবুবুল হক শাকিলকে নিয়ে, এর চেয়ে আর কী এমন স্বতঃসিদ্ধ লাইন লেখা যেতে পারে! লিখতে পারি আমি!

অবশ্য প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘মন খারাপের জলহাওয়া’ শিরোনামের ভূমিকা-পত্রে যেন আমার মনের কথাই লিখে রেখেছেন: ‘শাকিলের কবিতার কতগুলো নিজস্ব শর্ত আছে কবিতাগুলো প্রধানত অন্তর্মুখী, ভেতর-সন্ধানী (মনের, বস্তুর, নিসর্গের), তবে বাইরের পৃথিবীটাও জেগে থাকে এই অন্তর্লীন ভুবনের পরোক্ষে। বাইরের পৃথিবীতে থাকে কোলাহল, রাজনীতি, সমাজের ভালোমন্দ, মানুষের প্রেম-অপ্রেম, প্রেমের পূর্ণতা-অপূর্ণতা। কবিতাগুলোতে ভেতর-বাইরের এই দ্বন্দ্ব থাকে শুরু থেকেই, এবং তা কবির কথাগুলোকে কখনো উচ্চকিত, কখনো নমিত, কখনো আনন্দিত অথবা বিষণ্ণ করে। শাকিলের প্রতিটি কবিতায় একটি প্রধান চিন্তাই বড় হয়ে ধরা দেয়, সেই চিন্তা কখনো থাকে বিক্ষিপ্ত, কখনো সাজানো; কিন্তু চিন্তার রেশ ধরে কবিতার চিত্রকল্পরা তৈরি হয়, রং-ধ্বনি-দৃশ্য-গন্ধ নিয়ে জাগে। শাকিলের কবিতায় অস্থিরচিত্ততার প্রকাশটি প্রবল একটি দৃশ্যে, একটি মুহুর্তে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। তবে এই অস্থিরচিত্ততা কবিতার প্রকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং তাকে গতিময় করে।’

৩.
মরে যাবার রাতে
সুদীপা মরে গেছে আজ রাতে, একান্তে
প্রহসনের পূর্ণিমা যখন দারুণ পৌষময়।
রক্তে আগুন, সুদীপার আরো আগে মরে যায় প্রেম
সুদীপা মরে যায় রাতে, প্রেম মরে দিব্যকান্তি প্রভাতে।
আমাদের তুমুল প্রেম কান্না হয়ে ডানা ঝাপটায় উদ্বলিত বাতাসে
সুদীপারা মরে যাওায়ার আগে কিংবা পরে, তীব্র অনুরাগে, বেদনায়।
কাব্য করি, গল্পকথা, সুদীপার সাজানো সংসার
মুক্তো হয়ে ঘোরে জল, নিতান্ত অনধিকার যার।
(মন খারাপের গাড়ি, পৃ: ৯৪)

এই লেখাটির নাম ‘একটি মন খারাপের লেখা’ হবার কথা ছিলো না। এই রকম মৃত্যু ও মর্সিয়া উচ্চারিত হবার কথা ছিলো না কিছুতেই। এই রকম ‘শাকিল সংবাদ’ শোনার কথাও ভাবিনি কোনো দিন। সেই সন্ধ্যার আড্ডা শেষে যত বারই বইটির কথা ভেবেছি, একটি মন ভালো করার লেখাই লিখতে চেয়েছি। কিন্তু কে জানতো, একটি সংবাদের পর আর কিছু নয়, ওই সন্ধ্যাই শুধু লিখতে হবে, বেদনায়, কান্নায়, মন খারাপে, হাহাকারে?

দীর্ঘ দেহী শাকিল ভাইকে দেখলেই মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে, সর্বোপরী কবি হিসেবে, তাঁর হুদয়টি দেহের চেয়ে অনেকগুণ বড় বলেই মনে হয়েছে আমার। আহা শাকিল ভাই, কবি ও প্রেমিক শাকিল ভাই, প্রচ- আবেগে, প্রেমে, বিরহে, কবিতায় কখন যে ‘আত্মবিধ্বংসী কবি’ হয়ে উঠলেন, চল্লিশ পেরুতে না পেরুতে, ভালোবাসা, ক্ষমতা ও কবিতার ভেতর একা হতে হতে মন খারাপের গাড়িতে করে অন্যলোকের বাসিন্দা হয়ে গেলেন! অথচ কবি হিসেবে এই ২য় বইতেই কী জ্বলকে উঠেছিলেন! পেয়েছিলেন পাঠকের ভালোবাসা। শুধু বইমেলাতেই অন্বেষা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটির ৫/৬টি মুদ্রণ হয়েছিলো। অথচ বড় অবেলায় আমাদেরকে কান্না জড়িত কণ্ঠে পরতে হলো ‘প্রস্থানের গান’:
কোনো এক নক্ষত্রখচিত রাতে একাকী সে চলে যায়
পুরনো পাঁচালি, ঠাট্রার প্রহর, অগ্নিগর্ভ মিছিল ফেলে।
পেছনে হাতছানি, ছোটবেলার টিফিন বক্স, চালতার আচার
ভালোবাসার পাগলামি, প্রথম দেখা, ক্রমাগত অত্যাচার।
রেসের ঘোড়ার মতো জীবন কোথাও না কোথাও থেমে যায়
থেমে যায় অভিনয়, চাওয়া-পাওয়া, বৃহন্নলার নিষ্ফলা জীবন।
(মন খারাপের গাড়ি, পৃ: ৪৬)

প্রিয় শাকিল ভাই, এটা কি ঠিক হলো? কেনো তবে লিখেছিলেন ‘ভালোবাসা সরে দাঁড়াও, আমি বাঁচব কবিতায়, উন্মাদনায়’?