আমাদের দেশে ২০০৬ সালে শব্দদূষণ নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। এই নীতিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একইভাবে নীরব এলাকার জন্য এই শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর উপরে শব্দ সৃষ্টি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এই নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করছে সবাই। কেউ মানছে না। কানের ওপরে এসে হাউকাউ করে বাজিয়ে দিচ্ছে হর্ন। তীব্র আঘাত করছে আমাদের শ্রবণশক্তিতে।
বছর তিনেক আগে একটি বেসরকারী সংগঠনের পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় শব্দদূষণ মাত্রা ১০২ ডেসিবেল, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ৯৩ ডেসিবেল, বাংলামোটর এলাকায় ৯২ ডেসিবেল, সদরঘাট এলাকায় ৮৮ ডেসিবেল, ফার্মগেট এলাকায় ৯৩ ডেসিবেল, শাহবাগ এলাকায় ৮৬ ডেসিবেল, মহাখালীতে ৯৪ ডেসিবেল, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ১০১ ডেসিবেল, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৯৫ ডেসিবেল, গুলিস্তান এলাকায় ৯২ ডেসিবেল এবং স্কয়ার হাসপাতাল এলাকায় ১০৪ ডেসিবেল।
তবে এখন যদি কোন জরিপ পরিচালনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, এই শব্দদূষণের মাত্রা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে গাড়ির সংখ্যা বছর দুয়েক আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে নিশ্চয়! মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। ফলে বেড়েছে শব্দদূষণের মাত্রাও। এর গড় মাত্রা কোনভাবেই ১০৫ ডেসিবেলের কম হবে না।
শব্দদূষণের ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম হচ্ছে। আমাদের শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, শব্দদূষণের ফলে শুধু শ্রবণশক্তিই নয়, উচ্চরক্ত চাপ, মাথা ধরা, অজীর্ণ, পেপটিক আলসার, অনিদ্রা ও ফুসফুসে সমস্যাসহ নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট হয়, সন্তান সম্ভাবনা মায়েদের জন্য যেকোন ধরনের উচ্চ শব্দ মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধু তাই নয়, যানবাহনের শব্দ দূষণে ষ্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ায় বহুমাত্রায়। রাজধানী ঢাকার শব্দ দূষণের ভয়াবহ চিত্র সত্যিই আতংকজনক।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, যদি টানা ৮ ঘণ্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনা হয়, তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শব্দ দূষণ চোখ ও মাথার বিভিন্ন সমস্যার জন্যও দায়ী। শহরের বেশীরভাগ মানুষই মাথার যন্ত্রণায় ভোগে-যার অন্যতম কারণ শব্দ দূষণ। এছাড়া ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক এমনকি লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সারা বিশ্বে এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার পালিত হয় ‘আর্ন্তজাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস’। সারা বিশ্বেই এই দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নয়। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো বেশ সোচ্চার। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে তাদের রয়েছে বহুমুখী পদক্ষেপ। রয়েছে নীতিমালা। যে নীতিমালা তারা যথাযথ মেনে চলেন।
এ বিষয়ে আমার একটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। কিছুদিন আগে ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছিলো পূর্ব ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়ায়। ১১,৫০৬ বর্গ মাইলের দেশটি সাজানো দারুণভাবে। সবকিছু সুন্দর পরিকল্পিত, গোছানো। নয়দিন ছিলাম দেশটিতে। পাঁচদিন পর্যটন শহর সাঘকাদজর এবং চারদিন রাজধানী ইয়েরেভানে। ইয়েরেভান শহরটি যেন একটি পরিকল্পিত পার্ক। শহরটির বিভিন্ন দিকে ঘুরেছি। বহু পথ হেঁটেছি, রাস্তা পাড়ি দিয়েছি। বিস্মিত হয়েছি একটি বিষয়ে, আমি একটি বারের জন্যও কোন গাড়ির হর্ন শুনতে পাইনি! গাড়ির সংখ্যা যে খুব কম তা নয়। কিন্তু তারা সচেতন। তারা শিক্ষিত, তারা নীতিমালা মেনে চলেন। তারা আইন লংঘন করেন না। তারা মানুষের ক্ষতি করেন না। মানুষের প্রতি মানুষের গুরুত্বটি তারা খুব ভালো ভাবেই অনুধাবন করেন। এই কারণেই আর্মেনিয়া পৃথিবীর দশটি নিরাপদ রাষ্ট্রের মধ্যে নবমতম! আমরাও পারি না এমন সবকিছু পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে? পারি না মানুষ হয়ে মানুষের গুরুত্ব বুঝতে?
যাইহোক, শব্দ দূষণ তো আছেই। তার ওপর বায়ু দূষণ উদ্বিগ্ন করছে আমাদের। এই বায়ু দূষণ আমাদেরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। সামান্য একটু পথ হেঁটেই আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি। অথচ সেদিন আর্মেনিয়ার উঁচু উঁচু পাহাড়ের খাদে আমি সারাদিন হেঁটেছি প্রায়। বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। আর ঢাকা শহরে বাসা ছেড়ে বের হতে না হতেই দুর্বল হয়ে পড়ছি। এর অন্যতম কারণ, শব্দ দূষণের সাথে মাত্রারিক্ত বায়ু দূষণ। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তীব্র যানজট এবং ভঙ্গুর ট্রাফিক ব্যবস্থা। শাহবাগ থেকে নীলক্ষেত, পল্টন, ফার্মগেট, বিজয় সরণী, মহাখালী, বিমানবন্দর এলাকা, মগবাজার, কাকরাইল, হাইকোর্ট মোড়সহ প্রতিটি মোড়ে মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। কোথাও কোন ট্রাফিক সিগন্যাল ঠিক নেই। সমস্ত ট্রাফিক লাইট নষ্ট। বেচারা ট্রাফিক পুলিশ রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে হাত নেড়েই যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে কোন কোন গাড়িকে থামিয়ে পেছনের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন! কি করবেন! এতো কষ্ট কি করে সহ্য করবেন! ভয়ংকর প্রতিযোগিতার সময় হাত নেড়ে গাড়ি থামিয়ে দেওয়া দু:সাহসী ব্যাপার। কে শোনে কার কথা? যে যেদিক দিয়ে পারে গাড়িয়ে ঢুকিয়ে দেয়।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অতিষ্ট করে তোলার জন্য এই কয়েকটি ফ্যাক্টরই যথেষ্ট। একজন মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেয়ার জন্য এর চেয়ে বড় শত্রুর দকরার হয় না। তার ওপর যুক্ত হয়েছে রাস্তায় অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি। শয্যাশায়ী এই শহরের ওপর যেন ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’।
এভাবেই চলছে আমাদের প্রাণের ঢাকা। কী হবে এই শহরের? কী হবে আমাদের? কী হবে প্রায় তিন কোটি মানুষের? আমাদের বাঁচার স্বপ্ন কি থাকবে না? এভাবে আর বাঁচবো কতোকাল?