চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজীলত

‘লাইলাতুল কদর’ আরবী শব্দ, যাকে ‘শবে-কদর’ও বলা হয়। শবে কদর হলো ‘লাইলাতুল কদর’-এর ফারসী পরিভাষা। ‘শব’ অর্থ রাত, আর আরবী ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থও রাত বা রজনী। কদর অর্থ সম্মানিত, মহিমান্বিত, ভাগ্য। সুতরাং লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত রজনী, মহিমান্বিত রজনী বা ভাগ্যের রজনী। যেহেতু এ রাতের কৃত ইবাদত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম সেজন্য অথবা যেহেতু এ রাত্রে বান্দার পরবর্তী এক বৎসরের অবধারিত ভাগ্যলিপি ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয় সেজন্য এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয়।

ইবনে আবী হাতেম র. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের কাছে বনী ইসরাঈলের চারজন ব্যক্তি সর্ম্পকে আলোচনা করলেন যে, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করে অধিককাল যাবত ইবাদত করেন। এ সময়ের মধ্যে তারা একবারের জন্যও নাফরমানী করেননি। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং নিজেদের অল্প হায়াতের ব্যাপারে আফসোস করতে লাগলেন। সাহাবায়ে কেরামের এ আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীবের উপর সূরা কদর অবতীর্ণ করেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৮/৪৪৩) আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন, ‘আমি উহা (তথা কোরআন) কদরের রাতে নাযিল করেছি। তুমি কি জান, কদরের রাত কী? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম। ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ.) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন, ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত সে রাত পুরাপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার।’ (সূরা আল কদর)

পবিত্র কোরআন ও সহীহ-হাদীস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজীলত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ একটি সূরা নাযিল হওয়া এর গুরুত্ব ও ফজীলত প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ পাক নিজে এ রাতের চারটি ফজীলতের কথা উল্লেখ করেছেন।

১. এ রাত কোরআন নাযিলের রাত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লাওহে মাহফূজ থেকে দুনিয়ার আকাশে কোরআনকে এ রাতেই নাযিল করেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি উহা (তথা কোরআন) কদরের রাতে নাযিল করেছি।’ (সূরা কদর: ১) অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, ‘হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (আল কুরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সূরা আদ-দুখান: ১-৪) কোরআনের মতো বিরাট নিয়ামতের কারণেই মানব জাতির কাছে এ রাতে এতো মর্যাদা ও ফজীলত। এ কোরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানীত হবে, দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; গোটা জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে অর্থ বুঝে কোরআন পড়তে হবে। কোরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্তও করা যেতে পারে। যাদের কোরআনের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে, তারা এ রাতে একটি দারসও প্রস্তুত করতে পারেন। মাহে রমজানের এ রাতেই প্রায় প্রতিটি মসজিদে খতমে তারাবীহের কোরআন খতম সম্পন্ন করা হয়। এ রাতে ৩০ পারা কোরআনের শেষ পারা তিলাওয়াত করার মাধ্যমে হাফেজ সাহেবগণ তারাবীহ নামাজ পড়িয়ে থাকেন।

২. লাইলাতুল কদরে কৃত ইবাদাতের মূল্য হাজার মাসের কৃত ইবাদাতের চেয়ে উত্তম। হাজার মাস ৮৩ বৎসর ৪ মাস হয়ে থাকে। অর্থাৎ হাজার মাস ইবাদত-বন্দেগী করে যে সাওয়াব অর্জন করা যায়, সে সাওয়াব শুধু এক কদরের রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করেই অর্জন করা সম্ভব। এ জন্য যতটুকু পারা যায় ততটুকু ইবাদত করে কদরের রজনীকে কাটানো আমাদের জন্য জরুরী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ঈমানের সাথে, সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে আল্লাহর ইবাদতে কাটালো, তার বিগত জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী: ১৮৭৫) তাছাড়া বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও, তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর’। (বায়হাকী) তাই সারা রাত্র জাগরণ করে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগীতে মনোনিবেশ করা সকলের জন্য একান্ত কর্তব্য। বেশি বেশি নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, সালাতুস তাসবিহ, উমরী কাযা, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সাদকা, যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইসতেগফার, দুআ-দুরূদ, কবর যিয়ারত ইত্যাদি নফল আমলের মাধ্যমে এ রাতকে উদযাপন করা জরুরি। রমজানের শেষ দশক আসলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর বেঁধে ইবাদতে লেগে যেতেন, রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতেন। মা আয়েশা রা. বলেন, ‘আমি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমি জানতে পারি লাইলাতুল কদর কোন রাত, তবে কী আমল করব? তিনি জবাব দিলেন, তখন বেশি করে বলো, হে আল্লাহ! আপনি তো ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়। আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরিমিজী: ৩৫১৩])

৩. লাইলাতুল কদর ভাগ্য লিপিসহ ফেরেশতাদের আগমনের রাত। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ.) এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন।’ (সুরা কদর: ৩, ৪) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এ রাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সূরা আদ-দুখান: ৪) ফেরেশতাদের নাযিল হওয়ার অর্থ মুফাসসিরগণ করেছেন, যারা ইবাদতে লিপ্ত থাকেন তাদের সাথে ফেরেশতাগণ মুসাফাহা করেন। যেথায় বেশি ইবাদত-বন্দেগি হয়, সে জায়গা ফেরেশতাগণ পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর জিবরাইল আ.–এর আগমনের অর্থ হলো প্রতি লাইলাতুল কদরে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনান আর নবীজিও তাকে শোনান। এ বছর থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করে এ রাতেই ফেরেশতাদের কাছে অর্পণ করেন। (কুরতুবী: ২০/১৩৩) সেজন্য এ রাতে মহান রবের কাছে সৌভাগ্য কামনা করতে হবে। বিপদ-আপদ, বালা-মুসীবত থেকে ‍মুক্তি চাইতে হবে। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশ ও দশের জন্য বেশি করে দোআ করা এ রাতের একান্ত দায়িত্ব।

৪. চতুর্থ মর্যাদার কথা আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত এরাত শান্তিময়।’ (সূরা কদর: ৫) অর্থাৎ এ রাত পুরাটাই কল্যাণময়। এতে কোনো অকল্যাণ নেই। আর ফজর পর্যন্ত এর সীমা। অন্যান্য রাতে যেমন দোআ কবূলের জন্য শেষ রাতের আলাদা বিশেষত্য আছে, এর কোনো অংশ বেশি ফযীলতপূর্ণ এমন নয়; বরং পুরো রাতই বরকতময়, শান্তির আধার। অথবা এ রাতে কোনো বান্দাকে শয়তান কুপরামর্শ দিতে পারে না। কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ ফেরেশতারা ফজর পর্যন্ত ইবাদতগোজার বান্দাদের সালাম দিতে থাকে। (কুরতুবী: ২০/১৩৪)

রেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ