চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রোহিঙ্গা ইস্যুতে টেলিভিশন সাংবাদিকতা: নবীন সংবাদকর্মীর চোখে

সম্প্রতি রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিউজ টোয়েন্টিফোরের কয়েকটি রিপোর্ট বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। টিআরপি জরিপের কথা বলতে পারবো না, অন্তত সামাজিক মাধ্যমের চিত্র তাই বলে। চ্যানেল হিসেবে একেবারেই নবীন নিউজ টোয়েন্টিফোর। এর ফেসবুক পেজের বয়সও এক বছরের বেশি নয়। সেখানেই কয়েকটি রিপোর্ট দশ থেকে বিশ লাখবার পর্যন্ত দেখেছেন অনলাইন ব্যাবহারকারীরা। ভাইরাল হয়েছে ৮ থেকে ১০টি রিপোর্ট। মিডিয়াপাড়াতেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে কয়েকটি।

এর মধ্যে বাবা-মা হারানো এক রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে করা একটি রিপোর্ট নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল, হচ্ছে। অনলাইনেই অন্তত এক কোটি মানুষ দেখেছেন প্রতিবেদনটি। এছাড়া ‘খোলা আকাশের নিচে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম’, ‘কাঁটাতারে বিভীষিকা’, ‘অদৃশ্য অপরাধ: ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীরা’, ‘শরণার্থী জীবনের পথে’, ‘মুদ্রার উল্টো চিত্র’ রিপোর্টগুলোও সুনাম কুড়িয়েছে।

কী ছিল ওই রিপোর্টগুলোর মধ্যে? আমার মতে তেমন কিছুই ছিল না। অন্তত যতখানি আলোচনা হচ্ছে ততখানি সমৃদ্ধ রিপোর্ট সেগুলো নয়। মনে হয়েছে আরো ভাল করা যেতো, মানুষের হৃদয় ছোঁয়া যেতো আরো বেশি। এতোটা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারছি, কারণ রিপোর্টগুলো আমি নিজেই করেছিলাম। কেন? সে ব্যাখ্যায় পরে আসছি। তার আগে বলে নেই, আমি কোন একাডেমিক আলোচনায় যাবো না। কারণ সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র হলেও আমি বরাবরই ক্লাসের আলোচনায় খুব বেশি মনোযোগী ছিলাম না। তাই তাত্ত্বিক আলোচনা আমার মুখে রামনামের মতো শোনাতে পারে! আমি যেগুলো বলবো সেগুলো একেবারেই সাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে। যে জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে নিজের অর্ন্তদৃষ্টিতে দেখার দক্ষতাকে আমি বেশি প্রয়োজন বলে মনে করি।

অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্টে গত ৫ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ইস্যু কাভার করতে আমি কক্সবাজার যাই। ইভেন্টের গুরুত্ব বিবেচনায় সংবাদকর্মী হিসেবে এতো বড় ইস্যুতে আমি নবীন হিসেবেই নিজেকে ভেবেছি। যেখানে বিভন্ন সংবাদ মাধ্যমের বার্তাপ্রধান, প্রধান বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক, বিশেষ প্রতিনিধিরা গেছেন, সেখানে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করা আমার জন্য অস্বাভাবিক নয়। আর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ডজন ডজন দুনিয়া কাঁপানো সাংবাদিকরাতো ছিলেনই।

শরণার্থী অথবা অবৈধ অনুপ্রবেশ যাই বলি এ ধরনের ইভেন্ট কাভার করা আমার জন্য এটাই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সেখানে আমার কোন সোর্স ছিল না। শরণার্থী ক্যাম্পেও ঢুকেছি ওই প্রথম। আর তাই বড় কোন রিপোর্টের পেছনে না ছুটে, যা দেখেছি তাই নিয়ে রিপোর্ট করেছি। তবে চেষ্টা ছিল প্রতিটি রিপোর্টকে একটা গোছানো গল্পে পরিণত করার, উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়ার। কিন্তু একটি সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানোর ক্ষমতা রাখে এরকম কোন রিপোর্ট আমার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। সে চেষ্টাও আমি করতে যাইনি। আর নিউজ চ্যানেলগুলোতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লাইভের তাড়া, প্রতিদিন নিউজ প্রডিউস করার চাপ, ডে ইভেন্টের প্রতি আলাদা গুরুত্ব– সবমিলিয়ে একজন রিপোর্টার চাইলেও একটি বিশেষ রিপোর্টের পেছনে অফুরন্ত সময় দিতে পারেন না। এ কারণেই বলছি, আমার রিপোর্টগুলো যতোটুকু আলোচনার জন্ম দিয়েছে, ততোখানি সমৃদ্ধ ছিল কিনা নিজে জোর দিয়ে বলতে পারি না।

তবে যেসব গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন এই ইভেন্ট কাভার করতে, তারা এসব সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে থেকেই কাজ করতে পেরেছিলেন বলে আমার ধারণা। আর তাই সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও দিন শেষে অগ্রজদের ফেসবুক পেজ, টেলিভিশন, অনলাইন ফলো করেছি তারা কী করছেন, তা জানার জন্য। আমার যতদূর নজরে এসেছে তাতে একটি স্বনামধন্য নিউজ চ্যানেলের একজন প্রধান বার্তা সম্পাদকের একটি রিপোর্টের স্ক্রিপ্টিং খুব ভালো ছিল। যাতে মনে হয়েছে ওরকম স্ক্রিপ্টিং দক্ষতা অর্জন করতে আমাকে আরো কমপক্ষে একদশক সাংবাদিকতা করতে হবে। কিন্তু তিনি যে বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করেছেন তাতে অনুজ হিসেবে বা দর্শক সাংবাদিক হিসেবে আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। খুবই সাধারণ বিষয়গুলো নিয়েই সময় ব্যয় করেছেন টেলিভিশনের বেশিরভাগ অগ্রজেরা।

ঘটনার গভীরে যাওয়া, অনুসন্ধান করে কোন কিছু বের করে আনা অথবা কোন একটা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সহায়ক এমন কোন রিপোর্ট আমার চোখে পড়েনি, আলোচনা হতেও শুনিনি। খুবই সাদামাটা সাধারণ রিপোর্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে অনেক প্রতিথযশা সাংবাদিককে। যেগুলো আমাদের মতো নবীনদের জন্য ছেড়ে আসলেও, তারা হতাশ হতেন না বলে আমি মনে করি।

আরেকটা বড় দুর্বলতা দর্শক হিসেবে আমার মনে হয়েছে টিভি রিপোর্টগুলোর মেকিংয়ে। টেলিভিশন রিপোর্টে শুধু ভালো স্ক্রিপ্ট অথবা ভালো ছবি থাকলেই চলে না, সেটি গল্প হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সুন্দর একটি পরিকল্পনার। যেখানে একজন রিপোর্টার কিছুটা সিনেমার পরিচালকের মতো ভূমিকা পালন করেন। প্রথমে সাবজেক্ট ঠিক করেন এবং শেয়ার করেন তার সাথে থাকা ক্যামেরা পার্সনের সঙ্গে। ক্যামেরা পার্সন যখন ছবি নিতে থাকেন তখনই রিপোর্টার মাথার মধ্যে গল্প সাজাতে থাকেন, আর স্ক্রিপ্ট লেখার সময় মনে মনে ছবিগুলো গাঁথতে থাকেন। যখন স্ক্রিপ্ট লেখা হয়ে যায় তখনই তিনি তার পুরো রিপোর্ট চোখের সামনে দেখতে পান।

আর এই দৃশ্যটাই ভিডিও এডিটরের মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দেন সম্পাদনার টেবিলে যাওয়ার সাথেই। ভিডিও এডিটর যখন বুঝতে পারেন রিপোর্টার কি চাচ্ছেন তখনই একটি রিপোর্ট গল্প হয়ে ওঠে। অন্যথায় অনেক ভালো স্ক্রিপ্ট, ছবি, সাউন্ড বাইট থাকার পরও একটি ভালো রিপোর্ট করা সম্ভব হয় না। এ কারণে টেলিভিশন প্রতিবেদনকে রিপোর্ট না বলে স্টোরি বলা হয়। সহজ কথায় রিপোর্টারের কাজটা এখানে অনেকটা বাবুর্চির রান্নার মতো। তেল, নুন, ঘি, সবজি, মশলা বেশি বেশি দেয়ার পরও সবার খিচুরি খেতে মজা হয় না। আমি অন্তত টিভি রিপোর্টকে এভাবেই দেখি।

রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বেশ কিছু রিপোর্ট চোখে পড়েছে যেগুলোর মধ্যে অনেক ভালো এলিমেন্টস থাকার পরও সার্বিকভাবে একটা ভালো গল্প হয়ে ওঠেনি। সেখানে টিম ওয়ার্কের দুর্বলতা চোখে পড়েছে আমার নবীন অভিজ্ঞতায়।

আসা যাক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর কথায়। বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরাসহ শতাধিক বিদেশী গণমাধ্যম কাজ করেছে এই ইস্যু নিয়ে। যার মধ্যে বেশিরভাগেরই কয়েকটি করে টিম কাজ করেছে নানাবিধ প্রডাকশনকে মাথায় রেখে। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর উপর প্রত্যাশাটা আরো বেশি ছিল। স্টোরি টেলিং, ক্যামেরার কাজ, সম্পাদনায় দেশি চ্যানেলগুলোর মত দুর্বলতা চোখে পড়েনি। কিন্তু বিবিসির জনাথান হেডের ‘Who is burning down Rohingya villages?’ শিরোনামের রিপোর্টটি ছাড়া গেম চেঞ্জিং বা চ্যালেঞ্জিং রিপোর্ট করতে পারেনি আর কেউই। এমনকি এই ইভেন্টের শুরুর দিকে অর্থাৎ আগস্টের শেষ সপ্তাহ এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম দু’সপ্তাহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট দেখে মনে হয়েছে আগের বছরের রিপোর্টগুলোরই পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন তারা। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দু’সপ্তাহে সিএনএন, চ্যানেল ফোর ও আলজাজিরাতে ভালো কিছু স্টোরি চোখে পড়েছে। যেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র খুব ভালো ভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু এই সংকট সমাধানের পাথেয় হতে পারে অতখানি শক্তিশালী কোন রিপোর্ট তখনো আমার চোখে পড়েনি।

আমি জানি সব ইভেন্ট থেকে গেম চেঞ্জিং রিপোর্ট নাও আসতে পারে। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনো ভালো কাজের সুযোগ যে নেই তাও নয়। তারপরও দিন শেষে মনের মধ্যে খুঁতখুঁত করে আরেকটু ভালো সাংবাদিকতা হলে হয়তো মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর “জাতিগত নির্মূল” শব্দটাকে “গণহত্যা” প্রমাণ করা যেতো।

অনেকেই হয়তো এখনো সেটাকে গণহত্যাই বলছেন। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে সেটাকে জেনোসাইড বলতে পারছে না কেউই। হোক সেটা দেশি অথবা বিদেশি গণমাধ্যম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)