১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭। তখন রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে সরগরম গোটা বিশ্বের মিডিয়া। বাংলাদেশেই তখন সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্সসহ বিশ্বের বড় বড় সব গণমাধ্যমের কর্মীরা। বাংলাদেশের মিডিয়ার পাশাপাশি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোও লাইভে রোহিঙ্গাদের খবর প্রচার করছে। টিভি খুলেই তখন রোহিঙ্গাদের অবস্থাই জানতে চাইতো গোটা বিশ্ব। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতনের প্রতিবাদে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি তখন মুসলিম দেশগুলো ছাড়াও অন্যান্য দেশে অব্যাহত রয়েছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচির ছবি পোড়ানোর দৃশ্য তখন পত্রিকার পাতার প্রতিদিনের চিত্র। রোহিঙ্গাদের দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের একদিন পরই ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সফরে যান ঢাকায় কর্মরত প্রায় অর্ধশত বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা। এর আগের ক’দিন এসব কূটনীতিবিদদের কূটনৈতিকভাবেই রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বিষয়ে তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ।
১৩ সেপ্টেম্বর কূটনীতিকদের রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখানোর জন্য নিয়ে আসা হয়। মূলত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির যে চেষ্টা বাংলাদেশ শুরু করেছে তারই অংশ হিসেবে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশাল এই দলটিকে কক্সবাজার নিয়ে যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতরাও এ সফরে ছিলেন। এমনকি রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের অমানবিক অত্যাচারকে যে দেশগুলো নির্লজ্জভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছে সেই চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতরাও এ সফরের অংশ হয়েছিলো।
সেখানে তারা শরণার্থী ক্যাম্পে ঘরে ঘরে গিয়ে নতুন করে আসা শরণার্থীদের দুর্ভোগের কাহিনী শোনেন এবং কথা বলেন পুরনোদের সাথেও। কূটনীতিকরা স্থানীয় সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা তাদের নিজ নিজ সরকারের সাথে আলোচনা করবেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কূটনীতিকরা বেশ ঘানিকটা সময় ব্যয় করেন। রোহিঙ্গারা এ কূটনীতিকদের চেনেন না, তবে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি সাদা চামড়ার মানুষগুলো যে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করতে এগিয়ে আসছে এ বিষয়টি তারা জানতো। এদিনও কুতুপালং ক্যাম্প ছাড়িয়ে রাস্তায় দুপাশে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া ও তাদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরু হলেও ১৩ সেপ্টেম্বরও রোহিঙ্গা গ্রামগুলো জ্বলছিলো। আগুন দেওয়ার মাত্রা যেন আগের থেকে বেশিই লক্ষ্য করা গেছে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে। কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনের পর কূটনীতিকদের নিয়ে যাওয়া হয় সেই সীমান্তেই। কূটনীতিকরা পরে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলো পরিদর্শন করেন। সেদিন মিয়ানমারের ভেতরে সীমান্তের কাছে আগুনে পুড়তে থাকা গ্রামগুলো দেখে কূটনীতিকরা।
যে কূটনীতিকরা কক্সবাজার সফরে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিং করেন। তিনি তার ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। সন্ধ্যার দিকে ঢাকার পথে রওয়ানা হন রাষ্ট্রদূতরা। ১৩ সেপ্টেম্বর রাতেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। ভাবা হচ্ছিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বড় কোন সিদ্ধান্ত আসবে হয়ত! তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থার সুপারিশ ছিল না নিরাপত্তা পরিষদে। চীন ও রাশিয়ার ভেটোর কারণে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ একটি বিবৃতি দেয়। অবিলম্বে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের প্রতি আহবান জানায় জাতিসংঘ। জাতিসংঘের এ আহবানে বলা চলে কিছুটা আশার আলো দেখেছিলো বাংলাদেশ। তবে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন থাকায় জাতিসংঘের আহবানকে থোড়াই কেয়ার করেছে গণতন্ত্রের লেবাসধারী সামরিক বাহিনীর ইচ্ছায় পরিচালিত দেশ মিয়ানমার। জাতিসংঘের এ আহবানে অনেকেই ধারণা করেছিলো মিয়ানমার হয়ত নির্যাতন বন্ধ করে দেবে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের এ আহবানের পরও রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন যেন আরও বাড়ানো হয়। হঠাৎ করেই সীমান্তের কাছের গ্রামগুলোতে আরও বেশি করে আগুন দেওয়া শুরু করে বার্মিজ বাহিনী। আগের থেকে আরও বেশি রোহিঙ্গাদের ঢল তখন বাংলাদেশের দিকে।
তবে থেমে থাকেনি বাংলাদেশও। বাংলাদেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কূটনৈতিক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। যে কূটনীতিকরা বাংলাদেশের সীমান্ত সফর করেছেন তারা ঢাকায় ফিরে নিজ নিজ দেশগুলোর কাছে মিয়ানমার সীমান্তের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর প্রকৃত অবস্থা নিজ দেশের কাছে অবহিত করেন। বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বরাবরই বাংলাদেশের পক্ষেই বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখে মার্কিন সরকার। ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াতে থাকে। বৈশ্বিকভাবে কোনঠাসা হতে শুরু করে মিয়ানমার। আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বাতিল করলেও ক্রমাগত চাপের মুখে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দেন অং সান সুচি। (চলবে)