আমরা ১৩ জনের একটা টিম কক্সবাজার গিয়েছিলাম অফিসিয়াল ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, মিয়ানমার থেকে ‘জোরপূর্বক বিতাড়িত’ রাখাইন প্রদেশের নাগরিক, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা। তাদের সঙ্গে কথা বলা। এই মুহূর্তে তাদের বেঁচে থাকার অনিবার্য উপাদানগুলো কী হতে পারে, সেটা তাদের মুখে শোনা।
আমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে তিন দিনে বেশকিছু আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি, আবার ভয়ানক তাপ ও গরম উপেক্ষা করেই আমাদের এই অভিযান। আমরা সারাদিন নিজেদের মতো করে তথ্যসংগ্রহ করেছি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বিভিন্ন নারী-পুরুষ, স্থানীয় বাসিন্দা, ত্রাণকাজে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, সেনাসদস্য, জনপ্রতিনিধি, দোকানদার, সাংবাদিক, পরিবহন শ্রমিকসহ কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। প্রতিটি টিমে আমরা ছিলাম তিনজন। একজন থাকত যে কক্সবাজারের স্থানীয় ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে। মূলত সে দোভাষীর ভূমিকা পালন করত। আর একজন টিম লিডার, যে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প জমাত। আর অপরজন আলাপ-আলোচনার মূল পয়েন্টগুলো খাতায় টুকে নিত। সারাদিন চলত আমাদের দেখা, শোনা ও নোট নেয়ার কাজ। সন্ধ্যায় প্রতিটি টিমের সদস্য একত্র হয়ে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতাম। প্রত্যেক গ্রুপের ঝুলিতেই থাকতো বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প। আমাদের এই অভিজ্ঞতার কিছু চিত্র উপস্থাপন করছি।
একটা মজার ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক!
১৩ অক্টোবর, শুক্রবার সকাল। স্থান উখিয়ার বালুখালিতে অস্থায়ী আশ্রয় শিবির। একটি সংস্থা থেকে ত্রাণ আইটেম হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়া হয়েছে। যাদের দেয়া হয়েছে, তাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। এটা কি, কেন এ বিষয়ে ধারণা না থাকায় এক যুবক একটি ন্যাপকিনকে মাস্ক হিসেবে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তো আমাদের এক স্বাস্থ্যকর্মীর চোখে পড়ায় সে যুবকটিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, সে ওই জিনিস কেন নাকে লাগিয়ে ঘুরছে। জবাবে যুবক জানায় ল্যাট্রিনের গন্ধ থেকে রেহাই পেতে সে এটা লাগিয়েছে। সকালে সে এক ডাক্তারকেও এমন ‘মাস্ক’ ব্যবহার করতে দেখেছে! তখন স্বাস্থ্যকর্মীটি তাকে এই জিনিসটির ব্যবহার বিধি সম্পর্কে জানায়। এরপর ছেলেটি লজ্জিত হয়ে ওই বস্তুটি দ্রুত ফেলে দিয়ে দে ছুট!
আমরা মূলত উখিয়া উপজেলার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, টেকনাফের বাহারছড়া সমুদ্রউপকূলের শাপলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যাই। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র বা ক্যাম্পে চোখে পড়ে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করা কেবল মানুষ আর মানুষ!
প্রথমে এসেছিল অল্প কিছু মানুষ। এরপর নামে ঢল। এর কারণ হিসেবে আশ্রয়কেন্দ্রে যারা ঈদের আগে এসেছে তাদের ভাষ্য হলো: বাংলাদেশের আতিথেয়তা! দলে দলে আবারও রোহিঙ্গা ঢল নামার কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, একদিকে ওপারে অবস্থানগত দিক নিয়ে ভয়ানক ভীতি, অপরদিকে, বাংলাদেশে সহজে আশ্রয় ও ত্রাণ সহায়তা প্রাপ্তি এবং এর পাশাপাশি প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার ভরসা। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের নিয়ে সারা বিশ্বে যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে এবং এতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের সমর্থন মিলেছে সে ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে আশাবাদী হয়েছে। এ আশাবাদ ওপারে অবস্থানরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু একটা হবে- মূলত এ বিশ্বাসেই নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে ঢল নেমেছে। যে ঢল এখনও অব্যাহত আছে।
মিয়ানমার থেকে আসা যেসব মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তাদের সবার মধ্যেই এক ধরনের নিশ্চিন্ত মনোভাব দেখেছি। খাবার বা ত্রাণ নিয়ে সংকট খুব একটা চোখে পড়েনি। যেসব ঘরে আমরা প্রবেশ করেছি, সেখানে বরং চাল-ডালসহ ত্রাণসামগ্রীর মজুদ লক্ষ করেছি। অনেকে ত্রাণের অনেক সামগ্রী স্থানীয় জনগণের কাছে সস্তায় বিক্রি করছে, এমন দৃশ্যও আমরা দেখেছি। যারা বিক্রি করছে, তাদের মতে, তরিতরকারি, মাছ-মাংস কেনার জন্য তাদের নগদ টাকা দরকার। তাই তারা তাদের জন্য ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ ত্রাণ আইটেম বিক্রি করে দিচ্ছে। এই ‘বাড়তি’ ত্রাণ তারা কীভাবে, কোত্থেকে পেল, এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না দিয়ে ‘হেসে’ জবাব এড়িয়ে গেছে!
স্থানীয় ত্রাণকর্মীদের মতে, অনেকেই তথ্য ‘গোপন’ করে ১২ সদস্যের পরিবারকে চার-পাঁচটি পরিবার হিসেবে দেখিয়ে চার-পাঁচটি টোকেন সংগ্রহ করেছে। প্রতিটি টোকেনের বিপরীতে বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী সম্বলিত একটি করে ‘প্যাকেট’ দেয়া হয়। এর মধ্যে থাকে চাল-ডাল-আলু-লবণ-তেল-চিনিসহ আরও নানা দ্রব্যাদি। পাঁচ-ছয় সদস্যের একটি পরিবারের সাতদিনের খাবার হিসেবে এই ‘প্যাকেট’ মোটামুটি উপযুক্ত। কিন্তু নানা ফিকিরে যারা একাধিক প্যাকেট সংগ্রহ করছে, তারা বাড়তি অংশ বিক্রি করে ‘হাত-খরচ’ বাবদ কিছু নগদটাকারও সংস্থান করছে। প্রতিটি ক্যাম্পেই কম-বেশি এই চিত্র লক্ষ করা গেছে। এই ‘জালিয়াতি’ বন্ধের কার্যকর কোনো ম্যাকানিজম এখনও কর্তৃপক্ষ বের করেত পারেননি। তবে বিষয়টি তাদের ‘নলেজে আছে’ বলে জানিয়েছেন এক সেনাসদস্য।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব নেয়ার পর ত্রাণ বিতরণে এধরনের ‘অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা’ অনেকটা কমলেও এখনও আশ্রিত জনগোষ্ঠীর বেশ বড় একটা অংশ এই অবৈধ প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পরিবার। এই নতুন যোগ হওয়া পরিবারগুলো ত্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে একটু ভুগলেও শেষপর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে সবচেয়ে বেশি সংকট চোখে পড়েছে পানির। বিশেষ করে মূল সড়ক থেকে একটু দূরে ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে যে সব অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোতে সমস্যা খুব বেশি। টেকনাফের হোয়াইক্যং পুটিবনিয়া এলাকার অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরের পাশের খাল থেকে পানি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে নারী ও শিশুদের। প্রায় তিন কিলোমিটার দূর থেকে তারা অ্যালুমিনিয়ামের কলস আর প্লাস্টিকের বোতল ভরে পানি আনছিল উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাঁড়ির পাশ দিয়ে যখন নারী ও শিশুরা পানির পাত্র ভরে অতিকষ্টে যাচ্ছিল, তখন আমাদেরও বুকের ভেতরটা কেমন খাঁ-খাঁ করে উঠছিল!
পুটিবুনিয়ার এই আশ্রয়কেন্দ্রটি ছাড়াও টেকনাফে অনেকগুলো মাঝারি ও ছোট ছোট রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে নেচার পার্কের বস্তিটি বেশ বড়। এখানে লোকসংখ্যা ৫০ হাজারের ওপরে। এ ধরনের আরেকটি বস্তি হয়েছে বাহারছড়ায়। ছোট ছোট বস্তি হয়েছে জাদিমুড়া, মোচনি, দমদমিয়া এসব এলাকায়। আর সড়কের পাশ দিয়ে খানিক পরপর একটি-দুটি করে ঝুপড়িঘর রয়েছে অনেক। এসব ছোট-বড় বস্তি-ঝুপড়ির বাসিন্দারও নিরাপদ পানি বা শৌচাগারের তেমন কোনো সুবিধা বা ব্যবস্থা এখনও হয়নি।
উখিয়ার নতুন আশ্রয়কেন্দ্র থাইংখালিতেও সুপেয় পানি ও শৌচাগারের সুব্যবস্থা হয়নি। এখানেও লোকসংখ্যা দেড় লাখের ওপরে। এ ছাড়া টেংখালি, বাগগুনা, দক্ষিণ বাগগুনা, মক্কার বিল, মোচার খেলা এসব এলাকায় পাঁচ থেকে বিশ হাজার লোকের বস্তি গড়ে উঠেছে।
এসব আশ্রয়কেন্দ্রে এখন জ্বালানি সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। আশপাশের বনজঙ্গল-গাছগাছালি সব শেষ হয়ে গেছে। এখন রান্নার জ্বালানির জন্য তাদের মধ্যে চলছে হা-হুতাশ। যাদের হাতে নগদ টাকা আছে তারা লাকড়ি কিনে রান্না করছে। আর যাদের হাতে টাকা নেই তারা জ্বালানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে! আমরা যেখানেই গেছি, যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি, সবার জোর দাবি: আমাদের জন্য গ্যাসের চুলার এবং গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে দেন। পানি, শৌচাগার আর জ্বালানির বিষয়গুলো নিয়ে ত্রাণবিতরণকারী কর্তৃপক্ষের শিগগির উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
আরেকটি মজার ঘটনা দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করি। কোনো এক আশ্রয়কেন্দ্রের একটি তাবুর সামনে দেখি পলিথিনের বস্তা বিছিয়ে সেখানে শুকনো মরিচ ও চিড়া শুকাতে দেওয়া হয়েছে। চিড়া শুকাতে দেয়াতে আমার মনে কেমন ধন্দ জাগল। তাবুতে উঁকি দিয়ে এক প্রবীন ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম, চিড়া শুকাতে দিয়েছেন কেন? উত্তর: আমরা ওই জিনিস খাই না! ওগুলো খেলে ডায়রিয়া হয়! ওগুলো শুকাচ্ছি লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করব বলে!
প্রয়োজন, পছন্দ অনুযায়ী জিনিস না দিলে চিড়া হয়ে যায়, লাকড়ি (জ্বালানি), স্যানিটারি ন্যাপকিন হয়ে যায় যুবকের ‘মাস্ক’! এসব বিষয়ে ত্রাণবিতরণ কর্তৃপক্ষকে আরও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)