গত দশ বছরে রোবটিক্স বা রোবট দিয়ে নানা ধরনের কাজ করানোর যন্ত্র বাজারে এসেছে। এর সাথে একই সময় শুরু হয়েছে আমেরিকা, ইউরোপ ইত্যাদি দেশে তাদের হারানো ম্যানুফাকচারিং জবগুলো ফিরিয়ে নেবার পলিটিকাল আন্দোলন।
আগামী ১০ বছরে যা হবে তা হচ্ছে, রাজনৈতিক চাপ এর কারণে এবং রোবট টেকনোলজির অভূতপুর্ব উন্নতির কারনে, ‘লো টেক ম্যানুফাকচারিং’ এর যে কাজ গুলো এতো দিন বাংলাদেশে আসতো আমেরিকা বা ইউরোপে থেকে, সেগুলো সেই দেশ গুলতে ফেরত যাবে।
যেমন ধরুন রেডি মেইড গার্মেন্টস। বাংলাদেশের প্রায় ৯০% বিদেশে রপ্তানিজাত পণ্য হচ্ছে এই গার্মেন্টস। সারা পৃথিবীর সব চাইতে সস্তা শ্রমের বাজার বাংলাদেশ । ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো মাত্র ৩০-৪০ মাইল ব্যাসার্ধের জায়গায় কোটি কোটি অল্প শিক্ষিত, পরিশ্রমী তরুণ তরুণীর বসবাস পৃথিবীতে বিরল। এই একারণে লাখে লাখে গার্মেনটস এর কাজ বাংলাদেশে এসেছে। হাজারে হাজার ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে।
২০১৫ সালে আমেরিকার সেনাবাহিনী ৩ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল, এই টাকা দেয়া হবে বিজ্ঞানীদের যদি রেডি মেড গার্মেন্টস এর সেলাই করার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পারে এমন একটা রোবট কেউ বানাতে পারে।
এতোদিন পৃথিবীতে এমন কোন রোবট ছিল না যা দিয়ে দুই-তিন পিস কাপড়কে একসাথে জড়ো করে আস্তে আস্তে আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে সেলাই মেশিনে ঢুকিয়ে সেলাই করা যায়। শার্ট প্যান্ট বানানোর সময় এই কাজটি-ই আমাদের গার্মেন্টস এর শ্রমিকরা করে, যা এতদিন কোন রোবট করতে পারতো না।
সেলাই করার কাজটা করতে হাত, চোখ, আর মস্তিষ্কের মারাত্মক সমন্বয় লাগে, যা রোবট দিয়ে এতদিন করা যেতো না। গার্মেন্টসকে ঘিরে বাংলাদেশের বিশাল বড় সস্তা শ্রম বাজার গড়ে উঠার পেছনে এটাই হলো টেকনিকাল সিক্রেট।
২০১৬ সালের শুরুর দিকে আমেরিকার সেনা বাহিনীর ঘোষিত সেই পুরষ্কার জিতে নিয়েছে সফট-ওয়্যার অটোমেশন ইনক নামক একটি আমেরিকান কোম্পানি। কৃত্তিম বুদ্ধি আর রবোটিক হাত ওয়ালা গার্মেন্টস শ্রমিকের রোবট তারা বানিয়ে দেখিয়েছে।
আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই রোবট ইউরোপে, আমেরিকার বাজার সয়লাব করে ফেলবে বলে ধারণা করে নিতে পারেন।
এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে, একটা রোবট দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে, এবং তাকে বসাতে যা খরচ হবে, তা উঠে আসবে ১-২ বছরের মধ্যেই। তার পরে একটা রোবট ৬ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের সমান কাজ করতে পারবে, এবং তার বেতন বা মেইন্টেনেন্স খরচ হবে একজন বাংলাদেশি শ্রমিকের চাইতে অনেক কম।
রোবটিক্স এর হাত ধরে ইউরোপ-আমেরিকার গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং এর বিশাল একটা অংশ ইউরোপ-আমেরিকাতেই ফিরে আসবে, যদিও আগের মতো হাজারে হাজার গার্মেনটস কর্মীর চাকরি আর এই দেশ গুলতে ফিরবে না, কেননা রোবট দিয়েই সেই কাজগুলো করানো হবে।
চীন ইতোমধ্যে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্যে দুইটি প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছে। প্রথমত, রোবট বিপ্লবের আগেই চীন তার দেশের অর্থনীতিকে শ্রমিক নির্ভর ম্যানুফাকচারিং ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে, সার্ভিস ভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত করতে চেষ্ঠা করবে। আর দ্বিতীয়ত, নিজেরাই রোবট নির্ভর ম্যানুফাকচারিং এ চলে যাবে।
বাংলাদেশ, কেনিয়া, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের কোটি কোটি শ্রমিকের ভাগ্যে কি হবে, তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশের গার্মেন্টস ওয়ালাদের কারো কারো সাথে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। দেশের মাটিতে বসে মূলত দাসত্ব প্রথা চালাতে চালাতে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়া মালিক শ্রেণীর গার্মেন্টসওয়ালাদের মধ্যে ওভার কনফিডেন্স লক্ষ্য করেছি। এরা এই শীঘ্রই-আসন্ন রোবটিক্স বিপ্লবের বিপদ বুঝতে পারছে বলে আমার মনে হয় নাই।
দাসের ব্যাবসা মারাত্মক লাভের ব্যাবসা। এটা অনেকটা ড্রাগের ব্যাবসার মতো। মানব ইতিহাস বলে, এই ধরনের ব্যাবসা লাটে উঠার আগ পর্যন্ত খুব কম দাস ব্যাবসায়ি-ই বুঝতে পারে যে তার ব্যাবসা আর টিকবে না।
মনে রাখবেন, লাখে লাখে দাস হঠাত করে কর্ম হীন হয়ে গেলে পরেই মানব ইতিহাসের অনেক বড় বড় সামাজিক ঝড়, যুদ্ধ ও রেভলুশন গুলো অতীতে হয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)