চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাসেলের বাবা

এক।।
বাড়িটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে একটা বড়-সড় লঞ্চ বুঝি পথ হারিয়ে দূর কোনো দেশে চলেছে!

বাড়িটা এতই বড় যে এর পুরোটা ঘুরে ফিরে দেখতে গেলে ওর দম ফুরিয়ে যায়।
একতলা।
দোতলা।
তিনতলার খোলা ছাদ, একপাশে বাবার পড়ার ঘর। শুধু কি পড়ার ঘর! কখনো কখনো সময় সুযোগ পেলে বাবা সেই ঘরে বসে কি যেন লেখেন।
কি লেখেন বাবা!
খুব জানতে ইচ্ছে করে তার।
একদিন মাকে সে জিজ্ঞেসও করেছিল,
‘মা, বাবা টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কি লেখে? কবিতা!’
ছেলের কথা শুনে মা বেশ শব্দ করে হেসে ওঠেন। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসিটা আগের মতো ধরে রেখে বললেন,
‘হাসু, শুনে যা তোর ছোট ভাই কি বলে। শুনে যা-’
হাসু আপা বারান্দার এক কোণার ইজি-চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে গল্পের বই পড়ছিলেন।
মার কথা শুনে হাসু আপা ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালেন,
‘রাসেল তুই নিজে বাবাকে জিজ্ঞেস করিস, বাবা তো এ বাড়িতে তোকেই সবচেয়ে বেশী আদর করে।’
কথাটা বলে হাসু আপা আবার গল্পের বইয়ে মনোযোগী হয়ে উঠলেন।
রাসেলের আর বাবাকে কথাটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। সে অনেকবার ভেবেছে সাহস করে একদিন বাবাকে কথাটা বলবে। বলার সময় সে পেয়েছিল ঠিকই কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বাবার আশেপাশে সবসময় এত লোকজন ভিড় করে থাকে যে রাসেলের আর ইচ্ছে করেনি মানুষজনের ভীড় ঠেলে গিয়ে বাবাকে কথাটা বলে।
জন্মের পর থেকে রাসেল দেখে এসেছে তার বাবা সবসময় ব্যস্ত থাকেন। ঘরে যতটা সময় থাকেন তখনও কি বাবার একা থাকার জো আছে!
কত রকমের মানুষজন যে বাবাকে ঘিরে থাকে। আর বাবাটাও যেন কেমন!
সবাইকে নিয়ে থাকতেই যেন বাবার ভালো লাগে।



কখনো কখনো ঘুমের ভেতর রাসেল তার গালে, কপালে, মাথায় বাবার আদর মাখানো হাতের পরশ পেত। বাবার হাতের স্পর্শ পেলে, বাবার শরীরের গন্ধ পেলে তার ঘুম আপনা-আপনি হাল্কা হয়ে গেলেও রাসেল গভীর ঘুমের ভাণ করে বিছানায় ঘুমিয়েই থাকত। আর ঘুমের ভাণ করে ঘুমিয়ে থাকা রাসেল ঠিকই টের পেত তার ভীষণ ব্যস্ত বাবা, যে বাবাকে সারাদিন দেশের মানুষ ঘিরে থাকে সেই বাবা অনেক সকালে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে একটু সময় বাঁচিয়ে পরম ভালোবাসায় তার ছোট ফুটফুটে রাসেল সোনার কপালে, মাথায়, বুকে, চিবুকে, গালে, চুলে আদর করে দিত।

রাসেল তখন কিছু বলত না। ঘুমের মধ্যেও সে বাবার হাত ধরার চেষ্টা করত। বাবাও নিবিড় মমতায় রাসেলের হাত ধরত, রাসেলের নরম নরম কচি হাতের আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করত। বাবা রাসেলের পাশে বসে থেকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

দুই।।
বাবা সারাদিন পার্টি অফিস, মিটিং মিছিল-বক্তৃতা করে অনেক রাতে ঘরে ফিরে হাসু, রেহানা, কামাল, জামালের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খেতে খেতে সবার খোঁজখবর নেন। খাওয়ার সময় বাবা কত্ত রকমের গল্প যে করেন! বাবার গল্প শুনে মা হাসেন। হাসু আপা হাসেন। রেহানা আপা, কামাল ভাই জামাল ভাইও হাসেন। বাবার কথায় মা না হেসে পারেন না। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে বাবা নিজের পড়ার ঘরে কিছুটা সময় পত্রপত্রিকা পড়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুল গীতি শুনবেন। তারপর পাইপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে সামনের লেকের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়বেন।

বাবা ঘরে এসে দেখেন রেনু রাসেলকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। রেনু আর রাসেলকে অমন করে ঘুমাতে দেখে বাবার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
কেনো বাবার বুকের ভেতর থেকে অমন দীর্ঘশ্বাস বের হয়?
আবার কখনো কখনো উল্টোটাও হয়। খুব সকালে রাসেলের ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে পাশে শুয়ে থাকা বাবাকে মনপ্রাণ ঢেলে দেখে। বাবাকে কাছে থেকে তার খুব কমই দেখা হয়। আহারে!
বাবা যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন বাবাকে কেমন বাচ্চাছেলেদের মতো লাগে-রাসেল তার বাবাকে বাচ্চা ছেলেদের মতো দেখার জন্য প্রায়ই সকালবেলা আগে-ভাগে ঘুম থেকে জেগে যেত।

রাসেল যে প্রায় প্রতিদিনই সাতসকালে আগে-ভাগে ঘুম থেকে জেগে উঠত তা কি কখনো তার বাবা জানতে পেরেছে?
সকালবেলার আকুলি বিকুলি করা বরফিকাটা রোদ যখন বত্রিশ নম্বর বাড়ির দোতলার কোনার ঘরে ঘুমিয়ে থাকা বাবার মুখে এসে পড়ত তখন বাবাকে যে কি ভীষণরকম সুন্দর লাগত সেটা রাসেল ছাড়া আর কে জানে!

অলঙ্করণ কৃতজ্ঞতা: ধ্রুব এষ