হিজরি সনের সব মাসের কথা কিন্তু পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়নি। যদিও এক বছরে বারো মাসের সংখ্যার কথা কোরআনে উদ্ধৃত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা, যে দিন তিনি আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন, সে দিনই আল্লাহর কিতাবে তা নির্ধারিত হয়েছে।’ বাংলা ও ইংরেজি সনে কোরআন কর্তৃক নির্ধারিত বারো মাসের সংখ্যার হিসাব ঠিক রাখা হয়েছে। এটা ইসলামের বিরাট সৌন্দর্য। ইসলাম আপন রূপ-স্বাতন্ত্রে অনন্য এবং অন্য সবাই এর কাছে ঋণী, এটা তারই প্রমাণ বহন করে।
পবিত্র কোরআনে রমজান মাসের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় ‘রামাদ্বান’ শব্দের উর্দু উচ্চারণ ‘রমজান’। ভাষার ভিন্নতায় শব্দের উচ্চারণে ভিন্নতা তৈরি হওয়ার ঢের উদাহারণ সব ভাষাতেই আছে। এখানেও তাই। আমরা কোরআনে উল্লেখিত ‘রামাদ্বান’ শব্দ নিয়েই বিশ্লেষণ করি। শব্দটির অর্থ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সিয়ামের কার্যকারিতা ও উদ্দেশ্যের সাথে এর অর্থের অনিবার্য মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া যায়।
হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জীলানী (র.) তার বিখ্যাত কিতাব ‘গুনিয়াতুত তালেবীন’–এ উল্লেখ করেছেন, ‘রামাদ্বান’ শব্দটি ‘রমদ’ ধাতু হতে নির্গত বিশেষ রূপ, যার অর্থ পুড়িয়ে দেওয়া। এই মাসকে রামাদ্বান এ জন্য বলা হয় যে, আগুন কোনো বস্তুকে যেমন পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, এই মাসে ইমানদারের সিয়াম-সাধনা তেমনি গুনাহগারের গুনাহগুলোকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়।
বিশ্বখ্যাত তফসীর ‘রুহুল মায়ানী’ গ্রন্থে কোরআন ও ভাষা বিশারদ খলীল (র.)–এর একটি মত উল্লেখ করে রামাদ্বান শব্দের আরেকটি তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বসন্তের তীব্র খরার পর প্রথম বৃষ্টিকে আরবী ভাষায় রামাদ্বান বলা হয়। দীর্ঘ ওই রোদ্র-খরার পর বৃষ্টি হলে যেমন শুকনো মাটি উর্বর হয়ে উঠে, মাহে রমজানের সিয়ম-সাধনাও তেমনই। গুনাহ ও পাপাচারের ধারাবাহিক খরার উত্তাপে ইমানদার-গুনাহগারের চৌচির হয়ে যাওয়া কঠিন অন্তরকে পবিত্র মাহে রমজানের ভরপুর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত ওই বৃষ্টির মতই উর্বর ও সতেজ করে দেয়। তাই রমজান মাস আসার সাথে সাথেই আমরা নতুন দৃশ্য অবলোকন করি। মসজিদ বিমূখ মানুষগুলো ইবাদতের নেশায় মসজিদের দিকে ধেয়ে চলে। পাষাণ হৃদয়ের মানুষের চোখেও তাওবার অশ্রু বয়ে যায়। জীবনের ব্যস্ততায় অবিরত ছুটে চলা মানুষের কাছে ফরজ আদায়ের পরও মধুময় স্থীরতা নিয়ে নফল আদায়ের কী এক তৃপ্তিদায়ক অভিসার লক্ষ্য করা যায়। অজানা এক আকর্ষণে সবাই দৌঁড়ে যায় প্রভুর পরম শান্তির নীড়ে। খরতাপে সিয়াম পালন শেষে ২০ রাকাত তারাবীর কঠিন কাজকেও আল্লাহর সান্নিধ্য পালনে তীব্র এক চেতনা ও অনুপ্রেরণা মানুষের কাছে তুচ্ছ বানিয়ে দেয়। অদৃশ্য এক আহ্বান সবার কানে চলে যায় রমজান আসার প্রথম-লগ্নেই। আহবানের ঐ রশিতে আটকা পড়ে বে-নামাজিও মসজিদের কাতারে শামিল হয়ে যায়, গুনাহগার নেক আমলের নেশায় বিভোর হয়ে পড়ে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম অদৃশ্যের ঐ আহবানের কথাই বলেছেন পবিত্র এই হাদীসে, ‘রমজানের প্রথম রাতে আসমান থেকে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করে, হে নেক প্রত্যাশী এগিয়ে যাও; হে অন্যায়কারী থেমে যাও।’ মহান আল্লাহ নেক আমলের মাধ্যমে পুরো রমজান মাস উদযাপন করার সকলকে তাওফিক নসিব করুন। আমীন।
লেখক : মুফতি আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক, উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদ্রাসা