চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাজারবাগ থেকে বার্তা পাঠানো সেই ওয়্যারলেস অপারেটর, পাগলাঘণ্টি বাজানো সেই কনস্টেবল

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে, তখন সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পুলিশ লাইনে সহস্রাধিক বাঙালি পুলিশ সদস্য ছিলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন চার শতাধিক সদস্য। পাকিস্তানী হানাদারদের উন্নত অস্ত্র-সজ্জিত শক্তির সামনে থ্রি নট থ্রি রাইফেলস নিয়ে সেদিন বীরদর্পে লড়াই করেন পুলিশ সদস্যরা।

প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মো: শাহজাহান মিয়া ও আব্দুল আলী খান। যুদ্ধের শুরুতেই সারা দেশের পুলিশ স্টেশনগুলোতে বেতারের মাধ্যমে হানাদারদের আক্রমণের খবর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তখনকার ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া। জীবন বাজি রেখে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ লাইনের অভ্যন্তরে সৈন্যদের সতর্ক করেছিলেন তৎকালিন আইজি তসলিম উদ্দীনের দেহরক্ষী মো: আব্দুল আলী খান।

সেসঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে সেদিন তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের বুকে কম্পন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য।

২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবসকে সামনে রেখে দুই মহান মুক্তিযোদ্ধা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন কালরাতের অনেক অজানা কথা।

ওয়্যারলেসে সারাদেশে প্রতিরোধের ডাক পাঠানো কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া
১৯৪৯ সালের ১লা জুলাই নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা বড় বাড়িতে জন্ম শাহজাহান মিয়ার। শাহজানরা তিন ভাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।

শাহজাহান মিয়া ১৯৬৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে যোগ দেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের পরিদর্শক হন। তবে তাকে ১৯৮৫ সালে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল এরশাদ সরকার।

২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগের ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন ও প্রতিরোধযুদ্ধের নানান দিক সম্পর্কে শাহজাহান মিয়া বলেন: “১ মার্চে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিলে জনতার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠে বাংলাদেশ। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’। কথাগুলো কেবল সারাদেশের মানুষকেই না, রাজারবাগে যেসব পুলিশ কর্মরত ছিলেন তাদেরকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। রেসকোর্সের ওই সভায় আমরা (পুলিশ) কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম, আমরা ভীষণ উদ্বুদ্ধ হলাম। তখন থেকেই মনে হচ্ছিল বোধহয় একটা আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে। মনের মধ্যে একটা প্রতিবাদের ঝড় তৈরি হল।

“ধীরে ধীরে ঢাকা শহর উত্তাল হয়ে উঠলো। উত্তপ্ত-থমথমে পরিবেশ! কি জানি কি হয়ে যায়,” বলতে বলতে শাহজাহান মিয়ার চোখ ছলছল করে উঠে

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দুপুর ২টার পর থেকে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা নানা ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পেতে থাকেন। এরপরই কন্ট্রোল রুম থেকে শহরের বিভিন্নস্থানে পুলিশের টহল টিম পাঠানো হয়। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পুলিশ সদস্যরা খবর দিতে থাকেন যে শহরের পরিস্থিতি থমথমে ও জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাত ১০ টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে পুলিশের একটি টহল টিম বেতার মারফত জানায়, প্রায় ৩৭টি ট্রাকে করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানী সেনারা শহরে প্রবেশ করছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে খবর আসে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানে রমনা পার্কের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সাঁজোয়া যান অপেক্ষা করছে।

“খবর পেয়ে রাজারবাগে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল। ব্যারাকে থাকা পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র চাই…অস্ত্র চাই বলে চিৎকার করছিল। অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নিলো। রাজারবাগের তখন দুইটা পথ। একটা মালিবাগ মগবাজার হয়ে বাংলামটর অন্যটা চামেলীবাগ শান্তিনগর বেইলী রোড হয়ে। একটা পক্ষ ছিল চামেলীবাগে বর্তমানে যেখানে ইস্টার্নপ্লাস মার্কেট হয়েছে। সেখানে তখন ডন হাই স্কুলের ছাদে আমরা কয়েকজন অবস্থান নেই। সামনে ছিল পুলিশ-জনতার সম্মিলিত ব্যারিকেড। যেন পাকিস্তানী সেনাদের গাড়ি রাস্তা পার হতে না পারে।”

শাহজাহান মিয়া জানান, পাকিস্তানী সেনারা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলে প্রথমে ডন হাই স্কুলের ছাদ থেকে গুলি ছোড়া হয়। একজন পাকিস্তানী সেনা সেখানে নিহত হয়, আহত হয় একজন। পাকিস্তানীরা ভয় পেয়ে গেলো। তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগলো। অন্ধকার আকাশ গোলাবারুদে লাল হয়ে গেলো।

“আমরা বুঝতে পারছিলাম আমরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছি এটা সারা বাংলাদেশকে জানালে অন্যরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, প্রস্তুতি নেবে। তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মনে পড়লো। মনে হল আমার ওয়্যারলেস আমার অস্ত্র।”

“রাত তখন ১২টা। কারও হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজের বিবেকের তাড়নায় ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে একটা বার্তা দিলাম যেন পূর্ব বাংলার সকল বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে একটি মেসেজ যায়। মেসেজটা ছিলো এরকম-‘ওভার- বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ফস। ওভার এন্ড আউট’!”

শাহজাহান মিয়া বলেন, থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে তুুমুল প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু ‘রাত ১২টার দিকে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধ থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর মর্টার ও হেভি মেশিনগানের গুলির বর্ষণে। পুলিশ লাইন্সের চারটি ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় আটশ’ সদস্য ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে। এসময় তাদের হাতে অনেক বাঙালি পুলিশ সদস্য হতাহত হন। আটক হন ১৫০ জন পুলিশ সদস্য।

পরদিন ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।

“রক্তাক্ত ও সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে দলে দলে আমাদের রাজারবাগ থেকে বের করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসা নিতে রাজারবাগ হাসপাতালে গেলে অবাঙালি চিকিৎসকরা আমাদের কোনো চিকিৎসাও দেয়নি,” বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে আসছিল তার।

নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে খুব বেশি আক্ষেপ নেই তার। তবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য কোনো খেতাব না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ।

“স্বাধীনতার এতো বছর পরও রাষ্ট্রীয় কোন খেতাব পাইনি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যারা প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিল তারা কোনো খেতাব পেল না। জীবনের এই সময়ে শুধু একটা আক্ষেপই রয়ে গেল।”

তবুও তিনি চান দেশ অনেক উন্নত হোক। এগিয়ে যাক নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে। নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে শাহজাহান মিয়ার পরামর্শ: যে দেশ আমরা দিয়ে যাচ্ছি সেই দেশকে ভালবাসতে হবে মায়ের মতো।

‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই কালরাতে পাগলাঘণ্টা বাজিয়েছিলাম
২৫ মার্চের কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে হানাদার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সতর্ক করেছিলেন আব্দুল আলী খান। জীবন বাজি রেখে ঘণ্টা না বাজালে রাজারবাগ নিমিষেই ধ্বংস হতে পারতো। ঘুমন্ত বাঙালি পুলিশ বাহিনীর ওপর আরো ভয়াবহ আক্রমণ করতে সক্ষম হতো পাকিস্তানী সেনারা।

১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহ থেকে পুলিশে ভর্তি হন টগবগে তরুণ আব্দুল আলী খান।। একই বছরে এসএফ ফোর্সে যোগদান করেন তিনি। এসএফ ফোর্স নাম্বার ছিলো ৪৩৫১। ২৫ মার্চের কালরাতের সময় তৎকালিন আইজি তসলিম উদ্দীনের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২৫ মার্চে আব্দুল আলী খান ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স।

১৯৭৭ সালে জিয়া সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার হয় তার। ভাগ্যক্রমে মুক্ত হতে পেরেছিলেন তিনি।

“১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ চাকরি জীবন। এরপর আর কোন চাকরি হয়নি। সেই থেকে ২০০৯ সালে এসে আমাকে ডাকা হলো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আমাদেরকে রাজারবাগে ডাকা হয়। কিন্তু যেখানে যা বলি না কেন অনেকে বাধা দেয়,” বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে আব্দুল আলীম খান সেই কালরাতের বর্ণনা দিয়েছেন।

“দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ সেই ভাষণে আমিও উদ্বেলিত হয়েছি। সেইদিন থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সবাই তা জানেন। ২৫ মার্চ আমি সকালবেলা ডিউটি সেরে বিকাল বেলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাই। দেখলাম পরিস্থিতি উত্তপ্ত। আমার মনে শঙ্কা তৈরি হয়। কি যেন হতে যাচ্ছে! এই শঙ্কা নিয়েই রাত ৯টা দিকে রাজারবাগে ফিরে আসি। ঠিক রাত ১০টার দিকে বিদ্যুত চলে যায়। বাতি ধরিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে আশপাশে তাকিয়ে দেখি পুরো সিটিতে কোথাও বাতি নেই। রুমের ভেতরে গিয়ে শার্ট প্যান্ট এবং সাদা শার্ট পরে ভীত মনে নিচে নেমে এসে মাঠের আশপাশে ঘোরাফেরা করলাম।”

“একাকি পুকুর পাড়ে বসে চিন্তা ভাবনা করছি কী হতে পারে, কিছু হলে কী করবো ইত্যাদি। ভাবনা চিন্তা করতে করতে প্রায় এক ঘণ্টা চলে গেলেও বিদ্যুত আসে না। এখন টেলিযোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হতে পারে। ভালো হয় ওয়্যারলেসে মেসেজ যদি পাওয়া যায়। গেট থেকে উঠে এক নাম্বার রোডের সোজা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। মাঝপথে গিয়ে বাম দিকে টার্ন নিই। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাক দিলো। কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি আবারও হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে আবার ডাক পেলাম। ফিরে দেখলাম মোটর সাইকেল করে একজন আমার দিকে আসছেন। পাশে এসে আমি বাঙালি কিনা জানতে চাইলেন।”

“বাঙালি পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, কাকরাইল মোড়ে দেখে এলাম অনেকগুলো ট্রাক। সেনাবাহিনী সজ্জিত। আমার মনে হয় ফকিরাপুলের দিকে এসে এখানে আক্রমণ করতে পারে। কাজেই সতর্ক থাকবেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিয়ে এসেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তুমি যাও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে খবর দাও। হানাদার বাহিনী আজকে আক্রমণ করতে পারে। তারা যেন সতর্ক থাকে, যেন প্রতিরোধ গড়ে ‍তুলে।’ আমি দৌড় শুরু করলাম। আর চিৎকার করতে থাকলাম ‘ম্যাগজিনগার্ড, ম্যাগজিনগার্ড’ (অস্ত্রাগার)! কাউকে না পেয়ে আমি নিজেই পাগলা ঘণ্টা বাজাতে থাকলাম। দুই মিনিট ঘণ্টা পেটানোর পর এক-দেড়শ ফোর্স এসে হাজির। আমি তখন সেন্ট্রিকে বললাম চাবি নিয়ে আসো। কিন্তু চাবি পাওয়া গেলো না। পরে গুলি মেরে তালা ভেঙে আমি অস্ত্রাগারে প্রথম ঢুকি। গোলাবারুদ বিলি করে সৈন্যদের হাতে দিতে আমার কমপক্ষে ২৫ মিনিট সময় লেগে যায়। অস্ত্র নিয়ে বের হতেই পাশে দেখলাম আরেকটি অস্ত্রাগারের দরজা খোলা। এটা আমি পরে দেখেছি।”

তন বলন: আমি শেখ কামালের মারফতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই সেদিন ঘণ্টা বাজিয়েছি এবং নিজের হাতে অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছি। এগারটা ৩০ মিনিটে আমি নির্দেশ পাই, এগারটা ৩৫ মিনিটে আমি পাগলা ঘণ্টা বাজাই এবং ১১ টা ৩৮ মিনিটে গিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্র সাপ্লাই দিই।

“গোলাবারুদ ও অস্ত্র নিয়ে সৈন্যদের দিয়ে আমি রাজারবাগ ওয়ার্কশপের পাশে একটি নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিই। এদিকে বারটা বাজার ১৪/১৫ মিনিটের সময় থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। তখন দুই পক্ষের মধ্যে চলছে তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্রের সঙ্গে আমাদের অস্ত্রের অনেক দূরত্ব। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র। ওরা ৭ বা ৮ গাড়ি নিয়ে রাজারবাগে ঢোকার চেষ্টা করছে। তখনই প্রথম ফায়ার করে। এর ঠিক ৪ থেকে ৫ মিনিট পরে শান্তিনগর মোড়ে যুদ্ধ লেগে গেছে। প্রায় দুই ঘণ্টা তীব্র লড়াই চললো। আমাদের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানিরা রাজারবাগের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পরে তারা গাড়ি পেছনে সরিয়ে নিলো এবং কিছুটা শিথিলতার ভাব নিয়ে এলো। এটি ছিলো তাদের কৌশল।”

আব্দুল আলীম খান বলেন: আমার মনে হয়, প্রথমে তারা পুলিশের শক্ত অবস্থান বুঝতে পারেনি। এখানে আর্টিলারি ছাড়া দমন করা সম্ভব না, এটা তারা বুঝতে পেরে নতুন কৌশল নেয়। এক ঘণ্টা শিথিল থাকার পর বিশাল ট্যাংক, কামান চলে এলো। তিন দিক থেকে তারা ‘বোম্বিং’ শুরু করে।

“প্রথমেই আমাদের দুই তলা ভেঙে পড়ে গেলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো! এভাবে চলল অনেকক্ষণ। ঠিক সোয়া ৫টার দিকে আজান হতে শুনলাম। কিন্তু ‘আল্লাহু আকবর’ হতেই দেখলাম আজান থেমে গেলো। আমার সন্দেহ হলো যে, তারা আজান থামিয়ে দিয়েছে। আমি তখন ধীরে ধীরে বের হয়ে রাস্তায় গেলাম। দেখলাম, গাড়ি টহল দিচ্ছে। খুব সতর্কভাবে পুলিশ হাসপাতালে উঠে অবস্থান নিলাম। বেডের নিচে রাইফেল এবং গুলি রেখে জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। সারাদিন একটা লোকও বের হতে দেখিনি।

তিনি বলে যান: সন্ধ্যার পর আমি বেডশিট খুলে লুঙ্গি বানালাম। ভীতসন্ত্রস্ত মনে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কমলাপুর গেলাম। কমলাপুর থেকে রাস্তা ভুলে আমি নারায়ণগঞ্জ চলে গেলাম। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি কোন নৌকা নেই। আমার লক্ষ্য ছিলো ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ হয়ে চলে যাব ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর। সেখান থেকে ভারতে।

পাঁচদিন পর ভারতে পৌঁছার পর নিয়ে যাওয়া হয় মহিন্দ্রগঞ্জ থানায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রশিক্ষক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে শুরু করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ৭ মাস।এর মধ্যে দুই বার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ১১ নং সেক্টরে।

“যখন সর্বশেষ যৌথ আক্রমণ হয় তখন আমি পান্দা ক্যাম্পের ইনচার্জ হই। সেখান থেকে বিরিশিরি, বিজলপুর, জারিয়া, ঝাঞ্জাইল, নেত্রকোণা হয়ে মুক্ত ময়মনসিংহে ঢুকি ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১।”

তিনি বলেন: যু্দ্ধ শেষে আমি পুনরায় চাকরিতে যোগদান করি এবং আবারও আইজির দেহরক্ষী হিসেবে কাজ শুরু করি। খালেক সাহেব এলেন। তারপর রহিম সাহেব। রহিম সাহেবের পরে নূরুল সাহেব। ৭ মার্চের ভাষণের দিন আমি আইজির সঙ্গে মঞ্চেই ছিলাম।

সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্দীপ্ত আব্দুল আলী খান বলছেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন মুক্তির কথা বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধ করলাম। শহীদেরা রক্ত দিয়েছেন। বিনিময়ে দেশ পেয়েছি। কিন্তু জাতি তো মুক্ত হচ্ছে না।

“দেশের সবথেকে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের অভাব। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন সংস্কার। সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তবেই জাতি মুক্তি পাবে। শান্তি পাবে। এছাড়া বিকল্প কোন পথ আমি দেখছি না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যা চেয়েছিলাম তা পাচ্ছি না। এর জন্য আমি মর্মাহত, লজ্জিত, ব্যথিত।”