চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

রাজপথের মতো ক্যান্টনমেন্টেও বেজে যায় এরশাদের বিদায়ঘণ্টা

উনিশশ ৯০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে শুরু হওয়া আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মধ্য নভেম্বরের পর রাজপথের মতো ক্যান্টনমেন্টেও বেজে যায় প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের বিদায়ঘণ্টা। এক অনিবার্য গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। রক্তপাত এড়াতে সেনাবাহিনী এরশাদের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে তার সামনে পদত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। তার আগে পুলিশ বাহিনীও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও বুঝিয়ে দেন তারা জনগণের পক্ষে আছেন।

বিরাশি সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার বিরুদ্ধে বারবারই আন্দোলন হয়েছে। কখনো গুলি, কখনো মিছিলে ট্রাক, কখনো নিজের পেটোয়াবাহিনী দিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেন এরশাদ। এতে দীর্ঘ হতে থাকে নিহতের তালিকা। তবে এর মধ্যেই চলে যায় সাড়ে আট বছর। অবশেষে ৯০ সালের অক্টোবর মাসে এসে আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

ওই বছরের ১০ অক্টোবর তিন জোটের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ছাত্রদল নেতা জিহাদ নিহত হন। তার মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার পর দল-মত নির্বিশেষে সব ছাত্র সংগঠন এক হয়। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জিহাদের মরদেহ সামনে রেখেই শপথ নেন সবাই। কয়েকদিনের মধ্যে আরো হতাহতের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর টানা সাত দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে সবগুলো ছাত্রসংগঠন। প্রথমে তাদের জোট ২২ ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচিত থাকলেও পরে নাম হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য।

shofi-ahmed
শফী আহমেদ

সেসময়ের ছাত্রনেতা শফী আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ৮ নভেম্বর রাত ১০টায় জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির পাশে ছাত্রসংসদ কক্ষে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’র বৈঠক হয়। পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করাই ছিলো বৈঠকের মূল আলোচ্যসূচি। বৈঠকে ডাকসু ভিপি আমানুল্লাহ আমান, জিএস খায়রুল কবীর খোকন, ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব ও সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিলসহ অন্য ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে ৯ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পরের দিন সেটাই হয়।

পরদিন ঘোষিত কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ছিল: ১১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর ১২ নভেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমাবেশ, ১৩ নভেম্বর তেজগাঁওয়ে ছাত্র-শ্রমিক জনসভা, ১৪ নভেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধ্যাদেশ বাতিল, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং স্বৈরাচারী সরকার উচ্ছেদের লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও ও কালো পতাকা উত্তোলন, ১৫ নভেম্বর টঙ্গীতে ছাত্র-শ্রমিক সমাবেশ এবং ১৬ নভেম্বর নরসিংদীতে ছাত্র-কৃষক সমাবেশ।

এছাড়া ১৭ নভেম্বরকে গণদুশমন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এদিন মন্ত্রিপাড়া ঘেরাও এবং দেশব্যাপী ভুয়া এমপি, দুর্নীতিবাজ আমলা, লুটেরা এবং দালাল রাজনীতিবিদদের ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঘোষিত এই কর্মসূচিই এরশাদ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়।

বিশেষ দিনটিতে মন্ত্রীপাড়া অভিমুখে মিছিল ঠেকানোর জন্য পথে পথে পুলিশ-বিডিআরকে নামানো হয়। মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে মঞ্চ তৈরি করে পাল্টা সমাবেশ আয়োজনের খবরও পাই আমরা। ভেতরে ভেতরে সবার মনে অস্থিরতা। ওরা কি আমাদের হত্যা করবে? এ অবস্থায় শুধু সাহসে বুক বেঁধে এগোনো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিলাম না আমরা।

শফী আহমেদ বলেন, মন্ত্রীপাড়া ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা হওয়ার পর মন্ত্রীরা ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাস্তান আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। বিশেষ দিনটিতে মন্ত্রীপাড়া অভিমুখে মিছিল ঠেকানোর জন্য পথে পথে পুলিশ-বিডিআরকে নামানো হয়। মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে মঞ্চ তৈরি করে পাল্টা সমাবেশ আয়োজনের খবরও পাই আমরা। ভেতরে ভেতরে সবার মনে অস্থিরতা। ওরা কি আমাদের হত্যা করবে? এ অবস্থায় শুধু সাহসে বুক বেঁধে এগোনো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিলাম না আমরা।

90-revolution-2
সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সমাবেশ

গণদুশমন প্রতিরোধ দিবস পালন করার জন্য ১৭ নভেম্বর সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এক হয়। মিছিল নিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একদল যাবে মগবাজার চৌরাস্তার মোড়ে, সেখানে ঢাকা মহানগরী ছাত্র ঐক্য কর্মীদের জমায়েত হওয়ার কথা। ওই সমাবেশ থেকে একদল মন্ত্রীপাড়া অভিমুখে যাবে বলে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদলকে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে মন্ত্রীপাড়া যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে, পুলিশ এবং বিডিআরের পাশাপাশি রাস্তায় রাস্তায় সরকারের কিছু কর্মচারি ইউনিয়ন এবং মাস্তানবাহিনী জমায়েত হয়েছিল। সেদিন সকাল থেকেই ট্রাক বোঝাই করে লোকজন নিয়ে আসছিল সরকার সমর্থক জাতীয় পার্টি।

মগবাজার মোড়ে পুলিশি বাধার মুখে সমাবেশ করতে পারেননি ছাত্ররা। কিন্তু অন্য মিছিলটি কোনো বাধাই মানেনি। ডাকসু ভবনের নীচে ছাত্রনেতাদের বক্তৃতার পর মিছিল রওনা হয়। মিছিলটি পাবলিক লাইব্রেরি পেরিয়ে যাদুঘর পর্যন্ত যেতেই সরকারের মাস্তানদের বাধার মুখে পড়ে। পুলিশ প্রথমে বাধা দিতে এসেও পরে ডায়াবেটিক হাসপাতালের দিকে একটু সরে যায়। মুহূর্তেই হাজারো ছাত্র জনতার মিছিল ছুটে যায় শেরাটন হোটেলের দিকে। সেখানে এরশাদ সমর্থক ব্যাংক কর্মচারিদের নামে একটি মঞ্চ হয়েছিল। ওই মঞ্চ থেকে মাস্তানরা মুহুর্মূহু গুলি ও বোমা ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু এত ছাত্র দেখে ভয় পেয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মন্ত্রীপাড়ার দিকে দৌড়ে চলে যায় তারা।

শফী আহমেদ বলেন: এই হামলায় ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন মনিসহ অনেকে আহত হন। ডাকসু ভিপি আমান পায়ে ব্যথা পান, আমিও ব্যথা পাই হাঁটুতে। সারাদিন দফায় দফায় নানা স্থানে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শেষে অবশেষে মনে হয় মাস্তানদের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বেলা ২টার দিকে আচমকা মাস্তানরা সচিবালয়ের দিকে ছুটতে লাগে। সবদিক থেকে জনতার ঘেরাওয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মন্ত্রীপাড়া। মন্ত্রীপাড়া অভিযানে বিজয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।

তবে, এরপর আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে ছাত্রদলের কয়েকজনকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্দুকযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া হয়। ২৫ নভেম্বর ছাত্ররা হলগুলো মুক্ত করে। ২৬ নভেম্বর টিএসসিতে নিমাই নামে একজন চা বিক্রেতা নিহত হন। ২৭ নভেম্বর ডা. মিলন নিহত হলে ঢাকাসহ সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠে।

রাজপথ যখন উত্তাল তখন এরশাদের ক্ষমতার অন্যতম উৎস সামরিক বাহিনীতে কী ঘটছিল?

syed-ibrahim
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তখনকার ডিরেক্টর (মিলিটারি অপারেশন্স) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে সে সময়টা তুলে ধরেছেন। তার কথায় স্পষ্ট হয় বিশেষ করে ২১ নভেম্বরের (সশস্ত্র বাহিনী দিবসের) মধ্যে এরশাদকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, তার ক্ষমতার জন্য সেনাবাহিনী রক্তপাতে যেতে রাজি নয়। সেনাবাহিনীর এরকম অবস্থানে আর বাইরের উত্তাল পরিস্থিতিতে এরশাদ বুঝতে পারেন তার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

জেনারেল ইবরাহিম বলেন: আমরা পরিস্থিতি মোকাবেলা, মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ করছিলাম। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি জ্যেষ্ঠ অফিসারদের সঙ্গে চা নাস্তার মধ্যে আলাপ আলোচনা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা যাবে না, অনানুষ্ঠানিকভাবে এটা ছিলো মতবিনিময় এবং মতামতের মূল্যায়ন। তিনি ওই আলাপ থেকেই বুঝতে পারলেন যে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছেন।

সবাই বলে, সামরিক শাসন মানে সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত শাসন। আসলে শাসন কিন্তু সামরিক বাহিনী পরিচালনা করছিল না। সেটা করছিলেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং তার ঘনিষ্ঠ কিছু বাহিনী। প্রশ্ন উঠলো সামরিক বাহিনী এই দুর্নাম কেন নেবে?

তখনকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং পরে ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ঘটনায় মেজর জেনারেল থাকা অবস্থায় অবসরে যাওয়া ইবরাহিম সেনাবাহিনীর আত্মোপলব্ধির কথা তুলে ধরে বলেন: সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মনে একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। ৮২ সালের মার্চ মাসে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ মার্শাল ল দিলেন। চার বছর পর যেনতেন একটি নির্বাচন দিয়ে তিনি সেই মার্শাল ল থেকে বেসামরিক প্রশাসনে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনি অনেক ভালো কাজ করেছেন সেটা যেমন সত্য তেমনি তার অনেক বদনাম ও দুর্নীতি আছে সেটাও সত্য। কিন্তু সবাই বলে, সামরিক শাসন মানে সামরিক বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত শাসন। আসলে শাসন কিন্তু সামরিক বাহিনী পরিচালনা করছিল না। সেটা করছিলেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং তার ঘনিষ্ঠ কিছু বাহিনী। প্রশ্ন উঠলো সামরিক বাহিনী এই দুর্নাম কেন নেবে?

‘এ প্রশ্ন তোলা এবং এর উত্তর প্রকাশ্যে দেওয়া খুব কঠিন ছিল। কিন্তু অপ্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা ঐকমত্যের সৃষ্টি হয়েছিল যে, এরশাদ সাহেবের শাসন থেকে নিজেদের দূরে রাখা বাঞ্ছনীয়। এরশাদ সাহেব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার জন্য যদি পুনরায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চান তাহলে কঠোরভাবে আমরা সেখানে দ্বিমত পোষণ করবো। কথাটার মানে এমন দাঁড়ায় আপনি এরশাদ একজন রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই দেশ পরিচালনা করুন। সংকট মোকাবেলা করুন। আমাদের এখানে যুক্ত করবেন না। (চলবে)

(১৯৯০ সালে ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদকে বিদায় করা রাজপথের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে পুরো বাংলাদেশ। যেভাবে এ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে এবং তার কিছু নেপথ্য ঘটনাও অনেকের জানা। তবে, সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করায় যেভাবে জেনারেল এরশাদ পায়ের নীচে মাটি হারিয়ে ফেলেন সেই ঘটনা জানা নেই বেশিরভাগ মানুষের। ৯০ সালের উত্তাল সময়ে রাজপথের পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কী ঘটছিল সেই অজানা অধ্যায়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে ধারাবাহিক এ প্রতিবেদনে।)