চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং বৈধ অস্ত্রের অবৈধ কর্মকাণ্ড

গভীর রাত। ইস্কাটন রোডের একটি পানশালার প্রধান ফটকের সামনে একটি প্রাডো এসইউবি পার্ক করা। হেলে দুলে দুই যুবক বেরিয়ে আসতেই গাড়ির চালক দরজা খুলে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন। দু পাশ দিয়ে দুজন উঠে বসলেন। ধাম ধুম শব্দ করে দরজা টেনে নিলেন দু পাশ থেকে। ছোট গলি পথ পেরিয়ে প্রধান সড়কে ওঠেই জোরে পিকআপ দিয়ে ইউটার্ন করলো গাড়িটি, গন্তব্য এলিফ্যান্ড রোড।

রাত ২টার পরও রাস্তায় রিকশা-ভ্যান জাতীয় বাহনে সৃষ্ট জ্যাম দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো গাড়ির পেছনের সিটে বসা এক যুবকের। ড্রাইভারকে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানোর নির্দেশ দিলেন। কর্তার ইচ্ছায় চালকের কান ফাটানো হাইড্রলিক হর্নেও কর্ণপাত করছে না কেউ। কোমরে গোঁজা পিস্তলে হাত গেলো যুবকের। ম্যাগজিনে গুলি ভর্তি পিস্তল আনলক করে যুবকটি ট্রিগারে হাত দিলেন। তাকালেন এদিক ওদিক। গুলিবর্ষণ শুরু করলেন এলোপাতাড়ি। পাখির মতো লুটিয়ে পড়লো দুজন হতভাগা মানুষ। পিচঢালা পথে ছড়িয়ে পড়া ছোপ ছোপ রক্ত মাড়িয়ে লোকজন দিগ্বিদিক ছুটে গেলো। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে দু’যুবক পৌঁছে গেলেন বাড়ি।

বিদেশি কাউকে এমন গল্প বললে ভাবতে পারেন, অকারণে মানুষ খুনে উন্মত্ত সাইকো চরিত্র নির্ভর কোনো গল্প। শুরুতেই কল্পনার মূল চরিত্রের এন্ট্রি দেয়া হচ্ছে। আসলে তা নয়, একেবারে বাস্তব যা দেশের সকলের জানা। ঢাকা শহরে গতবছর ঘটে যাওয়া দুটি জোড়া খুনের মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বা এফআইআর থেকে নেয়া তথ্য। খুন দুটির জন্য অভিযুক্ত যুবকটি একজন নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের এক এমপির ছেলে। তার লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই গুলিবর্ষণ হয়েছে। মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন।

এ কাণ্ড ঘটানো যুবকটি এক এমপির ছেলে। মেরে না ফেললেও একইরকম ঘটনা ঘটিয়েছেন আর এক এমপি। তিনি গাইবান্ধার মঞ্জুুরুল ইসলাম লিটন। তার ঘটনাটি গভীর রাতে না, ভোরবেলায়। ভোরের আলো ফোটার সময়ে নিজের লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এক শিশুকে গুলি করেছিলেন ওই এমপি।

লোমহর্ষক, নৃশংস ও হৃদয় বিদারক এসব ঘটনার বিচার চলাকালীন সময়ে প্রায় এরকম আরেকটি ঘটনা ঘটলো সম্প্রতি। আরেক যুবক তার লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে হত্যা চেষ্টা চালালেন একজন রিকশা চালককে। নিরীহ রিকশা চালকের অপরাধ, তিনি গুলশান থেকে বনানি পর্যন্ত দু যুবককে নিয়ে এসে ভাড়া চেয়েছেন! এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যুবকটি গুলি চালিয়ে দিলেন নিরপরাধ, দিনমজুর রিকশা চালকের পায়ে। এ ঘটনায় পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্রসহ যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় জামিনও পেয়ে গেছেন সরকারী দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের থানা পর্যায়ের এই নেতা।

আওয়ামী লীগ সরকারের অসংখ্য ভালো কাজ এবং অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে এমন দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, অনেক ভালো কাজ করেও এসব কুলাঙ্গারের জন্য মানুষের কাছে সরকারের ভালো ভাবমূর্তি থাকছে না।

সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা সরকারের দায়িত্ব। এ বিষয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে দেশে হাজার হাজার বৈধ অস্ত্র সহজে কেন এবং কাদের দেয়া হয়েছে?

১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের নবযুগে রাজনৈতিক সরকারের আমল থেকেই ঢালাওভাবে দলীয় নেতা কর্মীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার শুরু যা এখনো অব্যাহত আছে। কেন্দ্রীয় নেতারাতো বটেই এমনকি ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের পাতি নেতা বা কর্মীদেরও দেখা যায় নিজেদের সঙ্গে বৈধ অস্ত্র বহন করতে। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় সোয়া দুই লাখ লাইসেন্স করা অস্ত্রধারী রয়েছেন। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স মূলতঃ দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব ও তদবিরে। মানা হয়নি নীতিমালা।

বাংলাদেশে ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট ও ১৯২৪ সালের আর্মস রুলস’র আওতায় সামরিক, বেসামরিক, অন্যান্য ব্যক্তিদের কিছু শর্তসাপেক্ষে শর্ট ও লং ব্যারেলের অনিষিদ্ধ বোরের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। সরকারের উপ-সচিব ও সশস্ত্র বাহিনীর মেজর ও এর উপরের কর্মকর্তা ও সম-মর্যাদার কর্মকর্তাদের বাইরে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতি যারা বছরে অন্তত ২ লাখ টাকা কর প্রদান করেন এবং পর পর তিন বছর একইভাবে কর প্রদান করেছেন তারা আবেদন ও লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন আরো অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। এই অস্ত্র তাদের ব্যক্তিগত ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য প্রদান করা হয়, মাতাল হয়ে কাউকে খুন করার জন্য নয়।

সোয়া দুই লাখ অস্ত্রের মালিকের দেশে ধরে নেয়া বাঞ্চনীয় যে দেশে অন্তত সোয়া দু লাখ মানুষ আছেন যারা উচ্চ আয় সম্পন্ন। তারা প্রত্যেকে বছরে সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা কর প্রদান করে থাকেন। বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। রাজনৈতিক প্রভাবে অনেকেই ভুয়া কাগজপত্র প্রদান করেই অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন, যাদের কোনো বৈধ আয়ই নেই। করও প্রদান করেন না বলে খবর বেরিয়েছে সংবাদমাধ্যমে।

দেশে প্রায় ১৯ লাখের কাছাকাছি মানুষের টিআইএন থাকলেও রিটার্ন দাখিল করেন ১৫ লাখের কম মানুষ। তাদের মধ্যে ০.৫% ভাগের বেশি বা ১০ হাজারের বেশি হবেন না যাদের দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে। এমনকি দেড় লাখের কাছাকাছি নিবন্ধিত কোম্পানির ৩০ ভাগের মালিক, কর্মকর্তা কর্মচারিদের এখনো করের আওতায় আনা যায়নি বলে শোনা যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, যেদেশে একটি বিলাসবহুল গাড়ির দাম দুই কোটি টাকারও বেশি, সে দেশে যাদের দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ নেই তারা এমন কি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী- শিল্পপতি যে তাদের জানমালের নিরাপত্তায় অস্ত্রের লাইসেন্স দিতে হবে? সত্যিকার ব্যবসায়ী ক’জনইবা অস্ত্রের লাইসেন্স চান বা পেয়ে থাকেন তার তথ্য অবশ্যই সরকারের কাছে রয়েছে। এনবিআর এই সোয়া দুই লাখ অস্ত্রের লাইসেন্সধারীর ঠিকানা সংগ্রহ করে খোঁজ নিতে পারে।

আসল কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মীরা ব্যবসায়ী সেজে এবং ভুয়া প্রমাণাদি দাখিল করে অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন করেন তা সকলের জানা। এমনকি আবেদনকারী অপরাধে জড়িত কি না এর তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশের কর্মকর্তাদেরও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাধ্য করেন এনওসি দিতে, এসব খবর বাতাসে উড়ে বেড়ায়।

পিস্তল বা রিভলবারের লাইসেন্সের আবেদনকারীকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হতে হয়। এক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হতে হয় যে আবেদনকারীর নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রটি আসলেই প্রয়োজন এবং তিনি অস্ত্রের অসৎ ব্যবহার করবেন না নিশ্চিত।

পক্ষান্তরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা অনুভবও করতে পারেন, আবেদনকারীর অস্ত্রটি অবৈধ কাজে ব্যবহারের আশংকা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক চাপে তাদেরকে বাধ্য করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পজিটিভ রিপোর্ট পাঠাতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাজনৈতিক নেতা হয়ে থাকেন, তাদেরও দলীয় নেতাদের সুপারিশ, তদবির ও চাপের বাইরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, ধারণা করা যায়। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন মামলার আসামি নূর হোসেন ও তার গ্রুপের অন্যদের কাছে অন্তত ৯ টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিলো, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা আগে থেকেই ছিলো, উদাহরণতো রয়েছেই।

ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কী ধারণা পোষণ করেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও গুণ্ডামির অভিযোগ নতুন নয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের প্রচুর শত্রুও তৈরি হয়। এ জন্য তারা দল ক্ষমতায় গেলে সবার আগে নেতাদের কাছে অন্তত: একটি আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য তদবির করেন এবং তা পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।

যারা গুণ্ডামি, চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের অস্ত্রও এসব কাজে ব্যবহার হবে, ভাবনাটা স্বাভাবিক। তারা এই অস্ত্র নিরীহ মানুষকে ভয় দেখাতে হরহামেশা ব্যবহার করে থাকেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। ঝালমুড়ির মতো সহজলভ্য করে রাজনৈতিক কর্মীদের হাতে বৈধ মারণাস্ত্র তুলে দিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে, তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সাংসদপুত্র রনি, সাংসদ লিটন এবং বনানীর যুবলীগ নেতা সোহেলের নৃশংস সন্ত্রাসের ঘটনা। এমন আরো অসংখ্য ঘটনার নজির অতীতেও আছে।

এভাবে যত্রতত্র অস্ত্রের ব্যবহার হলে সাধারণ মানুষের করণীয় কী, ভাবনার বিষয়। আত্মরক্ষার অধিকার তাদেরও আছে। এ অধিকারের সুরক্ষায় সাধারণ মানুষকেও কি অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হবে অবাধে, যারা রাজনীতিবদদের ভোট দিয়ে দেশ শাসনের ক্ষমতা দিচ্ছেন? নাকি রাজনৈতিক কর্মী সে গুণ্ডা, মাস্তান, চোর ডাকাত যাই হোক তার হাতে বৈধ অস্ত্র দিয়ে ভোটার মারার লাইসেন্স দেয়া অব্যাহত থাকবে শুধুমাত্র রাজনীতি করার কারণে? স্বীকার করতেই হবে, অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার আইন শৃংখলা রক্ষার স্বার্থেই সম্ভব নয়। কোন সভ্য দেশের জনগণের কাছে তা কাম্যও নয়।

এভাবে দলীয় কর্মী যারা সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাদের কাছে থাকা সকল বৈধ অস্ত্র ফিরিয়ে নেয়া সময়ের দাবি। তদন্ত করে ভুয়া প্রমাণাদি দাখিলের মাধ্যমে নেয়া সকল অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়। অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে তাদের অন্যান্য প্রমাণাদি সঠিক হলেও অস্ত্রের লাইসেন্স থাকা জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ বিবেচনার দাবি রাখে। তা না হলে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রবণতা বাড়তেই থাকবে যা ম্লান করে দেবে জনস্বার্থে নেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অসংখ্য ভালো উদ্যোগ ও সাফল্যকে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)