যাপিত জীবনে, আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে ‘সেরা সময়’ কোনটুকু? আমি দ্বিতীয়বার না ভেবে জবাব ফেরাই, শহীদ মাতা জাহানারা ইমাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য রাজপথে নেমে যে ডাক দিয়েছিলেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হাঁটাটাই এখন পর্যন্ত আমার সেরা সময় আর অর্জন।
একজন মা, হাসিমুখে তরুণ ছেলেকে যুদ্ধে পাঠালেন। একটি দেশের জন্য। তার দুই ছেলে, একজনকে তিনি উৎসর্গ করলেন, জেনে শুনে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। তার নাড়িছেঁড়া ধন রুমী শহীদ হলেন। প্রতিটি মানুষের জন্মের কিছু দায় থাকে। দায় থাকে জননী আর জন্মভূমির প্রতি। জাহানারা ইমাম জীবন দিয়ে সে দায় শোধ করেছেন। আমরা, আমি তার সঙ্গে হেঁটে আমাদের দায় মেটানোর চেষ্টা করেছি মাত্র।
২.
১৯৭১ সালে এ ভূখণ্ডে যে একটা যুদ্ধ হয়েছিলো, মুক্তির যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান নামে অনন্য একজন বাঙালি, তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছিল বিপুল সব আয়োজনে। জেনারেল জিয়া আর জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনে স্বাধীন বাংলাদেশকে নতুন করে ‘পাকিস্তানি টুপি’ পরিয়ে দেয়া হচ্ছিল। নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছিল ‘প্রকৃত ইতিহাস’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটা গণঅভ্যুত্থান হলো ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে গেলো সামরিক শাসক জিয়ার গড়া দল বিএনপির কব্জায়। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানকে সহায়তাকারী, প্রধান যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন জিয়াউর রহমান। আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামলে, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ঘোষণা করা হয়। প্রধান যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে নিয়ে আসার প্রতিবাদ হয়, নিন্দা হতে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বামী হারিয়েছেন। দেশের জন্য এক রুমীকে হারিয়ে তিনি শত-সহস্র মুক্তিযোদ্ধার ‘মা’ হয়েছেন। সেই মা নতুন করে ডাক দিলেন তার সন্তানদের। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের দাবি খুব স্পষ্ট আর জোরালো। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক দালালদের বিচার আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। জাহানারা ইমামের এই ডাকে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতা বিরোধী ‘অপশক্তি’ ছাড়া সকলেই সাড়া দেয়। ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে গঠিত হয় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’।
৩.
১৯৯২ সাল। রাজপথ তখন উত্তাল। জাহানারা ইমাম ছুটছেন পথ থেকে পথে। ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বসবে ‘গণআদালত’। সেই আদালতে বিচার হবে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের। জাহানারা ইমাম তার ছেলেদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সভা করছেন। ক্যান্সারধরা শরীরে ঘুমহীন-বিশ্রামহীন তিনি কাজ করছেন। সংগঠিত করে, এক মঞ্চে নিয়ে আসতে চাইছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে। এ যাত্রায় সফল হন তিনি।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সঙ্গে ‘প্রিয় প্রজন্ম’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। সময়টাই এমন, পত্রিকাটির সম্পাদক ফজলুল বারী আমাদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের খবর দিতে গিয়ে আমরা বিভাগের নাম দি ‘ছোট রাজাকার’।
জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল, রোকন রহমান, জুলফিকার আলি মাণিক, প্রভাষ আমিন, নঈম তারিক আর আমি, সঙ্গে ছিলেন আঁকিয়ে উত্তম সেন। এক সময় প্রিয় প্রজন্ম দাঁড়ায় গণআদালতের মুখপাত্র রূপে। ‘গোলাম আযমের ফাঁসি হবে গণআদালতে’-এই শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপা হয় প্রতি সংখ্যায়। সেখানে চলমান আন্দোলনের খবরের সঙ্গে আমি মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্টজন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মতামত জুড়ে দিতাম।
সেই বুলেটিনে আজকের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লেখক হুমায়ূন আহমেদ, বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর মতামত ছিল। মতামত আনতে গিয়েই বিচিত্রা অফিসে প্রথমবার মুখোমুখি হই পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক লেখক শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে। তিনি তখন এই আন্দোলনে জাহানারা ইমামের প্রধান ‘সিপাহসালার’। শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে সেই যে পরিচয় হলো, সেই থেকে আমি আজও আছি নির্মূল কমিটির আন্দোলনের সঙ্গে।
৪.
’৯২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে জনতার উত্তাল সমুদ্র থেকে রায় দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের অপরাধ মৃত্যুদণ্ড তুল্য। গণআদালতের সেই রায় বাস্তবায়নের জন্য আবেদন জানালে খালেদা জিয়ার সরকার উল্টো জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহ’ মামলা দায়ের করে।
সেই মামলা মাথায় নিয়েই ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট শহরের হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)