চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

যে কারণে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল সেনাবাহিনীতে

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে উপযুক্ত রদবদল আনায় সেনাবাহিনীতে যে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল তাতে ফাটল ধরে বিএনপি সরকার সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টায়। এ বিভাজন প্রথমে প্রকাশ পায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের সময় এবং চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ১৯৯৬ সালের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিভাজিত বাহিনীর মুখোমুখী অবস্থানের মধ্য দিয়ে।

ওই সময়ের ঘটনা বিশ্লেষেণ করে রচিত বিভিন্ন বইপত্রে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানে বিভাজনের পেছনে মূলতঃ দুটি কারণ উঠে আসে। তা হলো নির্বাচনে জিততে এবং বিরোধীদের দমনের সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের চেষ্টা এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির হাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সামরিক বাহিনীর ভার ন্যস্ত করা।

নির্বাচনে জিততে এবং বিরোধীদের দমনের সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের চেষ্টা
সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে বিরোধীদলগুলোর তুমুল আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে বে-আইনি অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয়। তবে অস্ত্র উদ্ধারের ছদ্মাবরণে এ অভিযান মূলত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতন করানোই সরকারের উদ্দ্যেশ ছিল বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

অস্ত্র উদ্ধারে নিয়োজিত সামরিক অফিসারদের হাতে ডিজিএফআই এবং এনএসআই’র তৈরি করা বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের একটি তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।

সেনাবাহিনীর একজন সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সরকার যেহেতু চেয়েছে তাই বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে আমরা মোতায়েন হই। কিন্তু আমরা দলমত নির্বিশেষে যখন অস্ত্র উদ্ধার শুরু করি তখন সরকারের এটি খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না। সেনাপ্রধানের হাতে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের একটি তালিকাও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে আমরা জানতে পারি।

‘কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি করে অভিযান পরিচালনা করে। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে অভিযান পরিচালনা করায় সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশ সরকারের বিরাগভাজনে পরিণত হয়।’

১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেসময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দ‍ারের অনুগত সেনাবাহিনীর একটি অংশ সরকারের রাজনৈতিক চাওয়ামতো কাজ করলেও অধিকাংশই পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়। এতে বিএনপিমনা এবং স্বতন্ত্রমনা অংশ চিহ্নিত হয়ে যায়।

এরপর ১৭ মার্চ জেনারেল নাসিমের নেতৃত্বে দেশের অবস্থা মূল্যায়নের জন্য সেনা সদরদপ্তরে ঢাকার সব ব্রিগেড কমান্ডার এবং দেশের সকল জিওসি’র একটি মূল্যায়ন সভা অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। সেই মূল্যায়ন বৈঠকেও বাহিনীর একটি অংশ সরাসরি সরকারপন্থী এবং অপরটি পেশাদার বলেও স্পষ্ট হয়।

৩০ মার্চ ক্ষমতা ছাড়ার আগে সেনাবাহিনীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল আনে বিএনপি সরকার। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামানকে বদলি করা হয় সাভারের ৯ম পদাতিক বাহিনীর জিওসি হিসেবে এবং সাভারের জিওসি মেজর জেনারেল এম এ মতিনকে করা হয় ডিজিএফআই’র মহাপরিচালক।

তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম নিজেই দাবি করেছেন: ‘ক্ষমতা ত্যাগের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) আমাকে সরাসরি অনুরোধ করেন নির্বাচনে তার দলকে বিজয়ী হতে সাহায্য করিবার জন্য।’

রাষ্ট্রপতির হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ার আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে যায় বিএনপি সরকার। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় রাষ্ট্রপতির হাতে।

বিশ্লেষকদের ধারণা, সেনাবাহিনীর ভেতর বিভাজন স্পষ্ট হয়ে যাওয়া এবং সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমসহ উর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা বিএনপির কথামতো কাজ না করায় সরকার ধারণা করে যে সেনাবাহিনীকে হয়তো নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না। সেই চিন্তা থেকেই সুকৌশলে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে যায় যাতে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে বাহিনীর উপর প্রভাব বিস্তার করা যায়। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি মনোনীত আব্দ‍ুর রহমান বিশ্বাস।

তবে এ সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্বাহী ক্ষমতাও যে রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে সে বিষয়টি প্রথমে স্পষ্ট ছিল না। সেটি প্রথমে স্পষ্ট হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ গ্রহণের পর।

শপথ নেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে যান সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম। পরদিন সকালে জেনালের নাসিমকে ফোন করে রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস বলেন, তুমি সবার সঙ্গে কল অন করছো আমার সঙ্গে করছো না। জবাবে নাসিম বলেন, আপনিতো আছেনই! কিন্তু রাষ্ট্রপতি তখন ত্রয়োদশ সংশোধনী পাঠের পরামর্শ দিয়ে নাসিমকে বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতির এরকম বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। কারণ: ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন, নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান, খালেদা জিয়ার জনসভাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ভ‍ূমিকা এবং গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রদবদল নিয়ে বিএনপি তথা রাষ্ট্রপতি এবং সেনাপ্রধানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি অংশ ছিল জেনারেল নাসিমের অনুগত এবং অপরটি রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের অনুগত।

নাসিম অনুগতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বগুড়ার জিওসি মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ খান, ময়মনসিংসের জিওসি মেজর জেনারেল আয়েনউদ্দিন এবং যশোরের জিওসি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।

অপরদিকে রাষ্ট্রপতির অনুগত ছিলেন তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, সাভারের জিওসি মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান এবং মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া।

রাষ্ট্রপতি সেনাপ্রধানকে উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৮ মে নাসিম অনুগত বগুড়ার জিওসি হেলাল মোর্শেদ খান এবং বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) উপ-মহাপরিচালক মিরন হামিদুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সেনাপ্রধান নাসিমও রাষ্ট্রপতি অনুগত চার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত (অ্যাটাচমেন্ট) করেন। তারা হলেন: তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম এবং বিডিআর সদর দপ্তরের ডিরেক্টর অপারেশন কর্নেল সালাম। এর মধ্যে শেষোক্ত দুজন ছিলেন সাঈদ এস্কান্দরের কোর্সমেট।

কিন্তু রাষ্ট্রপতির আদেশে দুজনকে বাধ্যতামূলক অবসর বা সেনাপ্রধানের আদেশে চারজনকে সংযুক্তির আদেশ আসলে মেনে নেয়নি কোন পক্ষই। তারা বরং অনুগতদের নিয়ে শক্তি প্রদর্শনের মহড়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

২০ মে রাতে রাষ্ট্রপতি অনুগত বাহিনী সেনাসদরে সেনাপ্রধান নাসিমকে ঘিরে ফেললে তিনিও তার অনুগতদের ঢাকা আসার নির্দেশ দেন। এভাবে দুপক্ষের মুখোমুখী অবস্থানে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নেয় রাষ্ট্রপতি অনুগত বাহিনী। আটক করা হয় জেনারেল নাসিমসহ ৭ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। সামরিক আদালত গঠনের মাধ্যমে এই সাতজনসহ মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। যার মধ্যে ৭ জনকে বরখাস্ত এবং আটজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

পরবর্তী ও শেষ কিস্তি: ছিয়ানব্বই’র মে মাসে সেনাবাহিনীর ভেতরে বাইরে যা ঘটেছিল