‘পতাকা’ ব্যবহারের শুরু হয়েছিল মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান নির্দেশক হিসেবে। তবে এক পর্যায়ে এসে বিভিন্ন জাহাজ ও জলযান কোন দেশের, তা বোঝাতে পতাকার ব্যবহার শুরু হয়।
মোটামুটি ১৬ থেকে ১৯ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় ‘এজ অব সেইল’ (Age of Sail)। এই সময়ে নদী বা সমুদ্রপথে যুদ্ধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চলছিল খুব বেশি। ফলে কোন জলযান কোন এলাকা থেকে পণ্য বা মানুষ নিয়ে যাচ্ছে তা জানার জন্য সনাক্তকারী চিহ্নের দরকার হয়ে পড়ে।
যুদ্ধ ছাড়া কোন দেশের পরিচায়ক বা প্রতীক হিসেবে পতাকার প্রচলনও ওই সময়টাতেই, ১৭ শতকের প্রথম দিকে। স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস রাণী প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের সিংহাসনও লাভ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ১৬০৩ সালে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের পতাকা একীভূত করে গ্রেট ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা তৈরি করেন।
১২ এপ্রিল, ১৬০৬ সালে ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ নামের ওই পতাকাটি রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন ও ব্যবহার চালু হয়। ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক, সেইন্ট প্যাট্রিকের লাল আড়াআড়ি ক্রসটিকেও ব্রিটেনের পতাকার সঙ্গে যোগ করে তৈরি হয় যুক্তরাজ্যের বর্তমান জাতীয় পতাকা।
চিহ্ন হিসেবে পতাকার ব্যবহার তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। তবে ‘জাতীয় পতাকা’ ধারণাটির উদ্ভাবন হয়েছে ১৮ শতকের দিকে। এমনটাই লিখেছেন পতাকা বিশেষজ্ঞ হুইটনি স্মিথ তার ‘ফ্ল্যাগস থ্রু দি এজেস অ্যান্ড অ্যাক্রস দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইয়ে। অবশ্য সেই পতাকাগুলো পুরনো বিভিন্ন পতাকা, চিহ্ন ও প্রতীক অবলম্বনেই এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
১৮ শতকের কয়েকশ’ বছর আগে রাজতন্ত্রগুলো বিশেষ চিহ্নযুক্ত হাতিয়ারের খাপ এবং ব্যানার ব্যবহার করেছে। এক সময় সেই চিহ্নগুলোই কিছুটা পাল্টে বা হুবহু অবস্থায় ওই এলাকার জাতীয় পতাকার স্বীকৃতি পেয়েছে।
জলপথে ব্যবহার ও দূর থেকে বোঝার সুবিধার জন্য পতাকাগুলো হতো মূলত চারকোনা আর মৌলিক রঙের তৈরি। সাথে কখনো থাকত সহজ কোনো নকশা। এগুলোই নৌ-প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে সময়ের সাথে জল থেকে স্থলেও ছড়িয়ে পড়ে একেকটি দেশের পরিচায়ক হিসেবে।
জলপথে এভাবে ছড়ানোর সময়টায় বিশ্বের সর্বত্র ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে পতাকার প্রচলন হতে থাকে। পতাকাহীন বেশিরভাগ দেশ ইউরোপের দখলে চলে যেতে থাকে। আর পতাকাহীন দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কুটনৈতিক সম্পর্কে যুক্ত হতে চাইলে নিজস্ব পতাকা তৈরি করতে বাধ্য করা হয়। অর্থাৎ নিজস্ব পতাকা নেই তো আলাদা পরিচয়ও নেই। ২০ শতক আসতে আসতে মোটামুটি কোন দেশই আর জাতীয় পতাকাহীন রইল না। জাতীয় প্রতীক, মুদ্রা আর জাতীয় সঙ্গীতের মতোই জাতীয় পতাকা প্রতিটি দেশের অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেল।
প্রথম জাতীয় পতাকা কোনটি – এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়, ১৩০৭ সাল বা তারও কিছু আগে প্রচলিত ডেনমার্কের পতাকাই বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো জাতীয় পতাকা। তবে এক্ষেত্রে লাটভিয়ার কথাও বলা হয়ে থাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯২৩ সালে তাদের জাতীয় পতাকা স্বীকৃতি পেলেও অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১২৮০ সালের দিক থেকেই পতাকাটি লাটভিয়ার পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের পতাকাটির উৎপত্তি ৮৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে বলে প্রচলিত লোককাহিনীতে বলা হলেও ১৫৪২ সালের আগে ‘স্কটল্যান্ডের পতাকা’ হিসেবে এর ব্যবহারের কোনো রেকর্ড নেই।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা
পতাকার ধারণা গ্রহণের পেছনে বিভিন্ন কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন নকশার পতাকা তৈরির পেছনেও থাকে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। যেমন, ফরাসি বিপ্লবের সময় জাতীয় পরিচায়ক হিসেবে ব্যবহৃত তিন রঙ থেকেই ফ্রান্সের বর্তমান জাতীয় পতাকাটি এসেছে। তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি ও বিবর্তনের পেছনেও রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক কারণ।
বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত পতাকার নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। জাপানের জাতীয় পতাকার নকশার সঙ্গে এর মিল রয়েছে। এর লাল বৃত্তটি একপাশে একটু চাপানো হয়েছে, পতাকা যখন উড়বে তখন যেন এটি পতাকার মাঝখানে দেখা যায়।
১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রদের এক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ নেয়ার কথা ছিল। এই উদ্দেশ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১০৮ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে আরও ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্য এবং মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান (খসরু) তখন ঢাকার নিউ মার্কেটের এক দর্জির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদে আজম হলের (বর্তমানে তিতুমীর হল) ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন ওই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবশেষে শখের আঁকিয়ে ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ তার নিপুণ হাতে মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে আঁকেন।
১৯৭১ সালের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা হিসেবে এই পতাকাটিই উত্তোলন করেছিলেন ছাত্র নেতা আ স ম আব্দুর রব। পূর্ব পাকিস্তানের চিহ্ন চাঁদ তারা ব্যবহার না করার জন্য নতুন এই প্রতীক তৈরি করা হয়েছিল। পাশাপাশি সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক অনুযায়ী বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি বোঝাতে পতাকায় সবুজ রং ব্যবহার করা হয়েছিল।
২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে এই পতাকাই উত্তোলন করেছিলেন। পরে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার নকশা সহজ করার জন্য শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইন করা পতাকার মাঝের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যাসহ পটূয়া কামরুল হাসানকে একটি প্রতিবেদন দিতে বলে। কামরুল হাসানের পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।