বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে মোকাবিলায় সন্ত্রাসবাদ থেকে মূলদৃষ্টি সরিয়ে প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা আশঙ্কা তৈরি করেছে।
অান্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা নীতি বিশ্বে আবারো স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে। কেউ আবার বলছেন, এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটখাটো যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
শনিবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ নয়, বরং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতাই আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আর তাই কংগ্রেসের কাছে বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াতে আবেদন জানানো হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রতিরক্ষা তথা সামরিকখাতে যুক্তরাষ্ট্র নজর দেওয়ায় বৈশ্বিক রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে? চ্যানেল আই অনলাইনের এমন প্রশ্নে বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনাপ্রধান হারুন অর রশিদ।
তারা মনে করছেন, পেন্টাগনের এ ঘোষণা যদি কার্যকর হয় তাতে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। তবে অস্ত্রের মহড়া বা ব্যবহারের ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন যায়গায় ছোটখাটো যুদ্ধ বাঁধতে পারে। আর সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সরে গেলে সেখান সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
পেন্টাগনের নতুন এ ঘোষণা বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ বলছেন, ‘নতুন এই নীতি স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের মতো। এর ফলে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হবে। এক ধরনের ‘বিকল্প যুদ্ধ’ শুরু হবে। আবার যেসব দেশগুলো সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে, সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করছেন স্নায়ুযুদ্ধের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা কম।
তিনি বলেন: ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই ধারণা করা হচ্ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে তাদের বরাদ্দ বাড়াবে বা এ খাতটিই তাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে। সাম্প্রতিক এ ঘোষণা তারই প্রতিফলন। তাদের এ সিদ্ধান্তে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া চীন-রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিপক্ষ মনে করলেও স্নায়ুযুদ্ধের মত পরিস্থিতি আর সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না।
একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করে মেজর জেনারেল (অব.) হারুন অর রশিদ বলেন: বিশ্ব আর দুই কেন্দ্র বা দুই পরাশক্তিতে বিভক্ত নেই। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পাশাপাশি চীন উঠে এসেছে; ভারতও উঠে আসছে। সুতরাং স্নায়ুযুদ্ধের মত অবস্থায় নেই বৈশ্বিক পরিস্থিতি। নতুন করে সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও কম।
তবে সন্ত্রাসবাদ থেকে যুক্তরাষ্ট্র দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ায় বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন: যেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ রয়েছে তাদের ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের চাপ ছিল। সে চাপ শিথিল হয়ে গেলে ওইসব রাষ্ট্রে সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নতুন প্রস্তাবিত জাতীয় পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণার পর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ম্যাটিস বলেছেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্থব্যয় না করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ দেয়া দরকার। চীন বা রাশিয়ার মতো পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হতে পারে। তাই তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামরিক শক্তি বাড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্রের যে বাড়তি অস্ত্র মজুদ হবে, সে অস্ত্রের মহড়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন প্রান্তে ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
অবশ্য প্রতিরক্ষাখাতের দিকে বেশি নজর দেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারলেও এতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। বরং তা আরও ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।