চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

যাবজ্জীবন ও আমৃত্যু বিতর্ক

যাবজ্জীবন শব্দের মানেই হলো যতদিন জীবন আছে অর্থাৎ আমৃত্যু। কিন্তু যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড কি না, তা নিয়ে নানারকম দ্বিধা ছিল। তবে সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ আপিল বিভাগ পরিস্কার বলে দিয়েছেন, যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড। ২৪ এপ্রিল আপিল বিভাগের এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রায়টি দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ যেখানে বলা হয়, যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছর কারাভোগ নয়, আমৃত্যু কারাবাস। তার মানে কেউ যদি ২০ বছর বয়সে যাবজ্জীবন সাজা পান এবং তিনি যদি ৮০ বছরও বেঁচে থাকেন, তাহলে তাকে জীবনের বাকি ৬০ বছরই জেলখানায় কাটাতে হবে।

দণ্ডবিধির ৫৭ ধারায় বলা আছে, In calculating fractions of terms of punishment, [ imprisonment] for life shall be reckoned as equivalent to [ rigorous imprisonment for thirty years]. অর্থাৎ “দণ্ডের মেয়াদসমূহের ভগ্নাংশসমূহ হিসাব করার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে ত্রিশ বছর কারাদণ্ডের সমান বলে ধরা হবে।’’ তবে এই ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, এটি শুধু কোনো আসামির সাজা কমানোর ক্ষেত্রে ধর্তব্য হবে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন বলতে ত্রিশ বছর বলা যাবে না। অর্থাৎ যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত কোনো আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত কারাবরণ করতে হবে, যদি না তার ব্যবহার বা অন্যকিছু বিবেচনায় শাস্তি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

১৯৯৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সার্কুলারে কারাদণ্ডের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত ধার্য করা হয়। তবে কারাগারে ভালো আচরণের জন্য জেল কোড অনুযায়ী ৩০ বছরের আগেও অনেক কয়েদি মুক্তি পান। আর জেলের বছর যেহেতু ৯ মাসে, তাই কেউ যাবজ্জীবন বা ৩০ বছর সাজা পেলেও ২২ বছরে বের হয়ে যান।

মো. হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায়ও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে তার জীবনের সমস্ত দিনগুলো কারাগারে কাটাতে হবে না, বরং ৩০ বছর পর্যন্ত কারাগারে থাকার পর ছাড়া পেতে পারে। প্রসঙ্গত, আগে যাবজ্জীন কারাদণ্ডের মেয়াদ ধরা হত ১৪ বছর, স্বাধীনতার পরে সেটি ২০ বছর এবং ১৯৮৫ সাল থেকে তা ৩০ বছর করা হয়।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিএনপি নেতা মৃত আব্দুল আলীমকে প্রথম আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিষয়টি তখনই আলোচনায় আসে। এরপর আপিল বিভাগ আরেক মানবতাবিরোধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের বদলে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়ার পর এ নিয়ে মতভেদ ও তর্ক শুরু হয়। কেননা বাংলাদেশের দণ্ডবিধি ও বিশেষ আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও আমৃত্যু কারাদণ্ডের কথা স্পষ্ট করে বলা নেই।

আইনজীবীদের অনেকে মনে করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা যেহেতু বিশেষ আইনের অধীনে বিচার করা হয়, সেহেতু আমৃত্যুর ধারণা নতুন বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় কাউকে এইশো বছর কারাদণ্ডও দেয়া হয়। যেমন ২০১৫ সালের ১৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো রাজ্যের সাবেক এক নারী নার্স একজন গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে বাচ্চা নিয়ে গিয়েছিলেন আর সেই অপরাধে গত বছর আদালত ডায়নেল লেইন নামে ওই নার্সকে ১০০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই নার্সের বর্তমান বয়স ৩৬। তার মানে আরও একশো বছর অর্থাৎ ১৩৬ বছর পর্যন্ত তার বাঁচার যেহেতু সম্ভাবনা নেই, ‍সুতরাং এখানে ১০০ বছর সাজা মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড, যদি আদালত বা রাষ্ট্র তার সাজা কোনো কারণে না কমায়।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালের ক্রিমিন্যাল আপিল মামলার (নং ১৫-১৬) রায়ে আপিল বিভাগ ৯২ পৃষ্ঠার যে রায় দিয়েছেন তার ৮৯ ও ৯০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, Life imprisonment within the meaning of section 53 read with section 45 of the Penal Code means imprisonment for rest of the life of the convict. অর্থাৎ দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৪৫ ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে, যার মানে দাঁড়ায় যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড।

তবে আদালত এও বলেছেন যে, In exercise of power under article 49 of the constitution the President has power to grant pardon, reprieves and respite and to remit, suspend or commute any sentence even after the commutation of sentence by this court or the High Court Division. সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে অপরাধ ক্ষমা করা, শাস্তি মুলতবি রাখা, শাস্তির মেয়াদ কমানো বা দণ্ড মওকুফ করে দেবার ক্ষমতা রয়েছে।আবার কারাগারে বন্দির আচরণ এবং মানবিক কারণেও অনেক সময় সাজা কমানো হয়।

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া সবার ক্ষেত্রেই আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিধান প্রযোজ্য কি না? রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম মনে করেন,যাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, শুধু তাদেরই আমৃত্যু কারাগারে কাটাতে হবে।অর্থাৎ বিভিন্ন মামলায় যাদের যাবজ্জীবন সাজা হবে, তাদের মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে না। তারা দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩০ বছর অর্থাৎ জেলখানায় ৯ মাসে বছর হিসেবে ২২ বছর জেল খেটেই বের হবেন।

বিষয়টা এরকম যে, যার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের সমান অর্থাৎ আদালত যাকে তার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন কিন্তু আপিলে যিনি মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছেন, তার ক্ষেত্রেই যাবজ্জীবন মানে হবে আমৃত্যু জেল। অর্থাৎ তার ক্ষেত্রে ৩০ বছর (২২ বছর)কারাবাসের বিধান প্রযোজ্য হবে না। তাকে মৃত্যুবধিই কারাগারে থাকতে হবে।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড সম্পর্কিত আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে এখন ফৌজদারি দণ্ডবিধি বা পেনাল কোড সংশোধন প্রয়োজন হবে কি না? কেননা অনেকের কাছেই মনে হতে পারে যে, দণ্ডবিধির ৫৭ ধারার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। যদিও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পরিস্কার করেই বলে দিয়েছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। বরং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ হচ্ছে দণ্ডিত ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ৩০ বছর, এটির অপব্যাখ্যা হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।

১৯৬১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথম রায় দিয়েছিলেন যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে দণ্ডিত ব্যক্তির আমৃত্যু কারাবাস। অর্থাৎ সে দেশেও বিষয়টি নিয়ে জটিলতা আছে বলে যাবজ্জীবনের ব্যাখ্যার জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ফলে যাবজ্জীবন কারাদ্ণ্ড পাওয়া সবার ক্ষেত্রেই আমৃত্যু কারাদণ্ড বোঝাবে নাকি অ্যাটর্নি জেনারেল যেরকমটি বলছেন যে, এটি কেবল মৃত্যুদণ্ডের বদলে কাউকে যাবজ্জীবন দেয়া হলে তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে-সেটি আরও পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। আশা করা যায়, আপিল বিভাগের রায়টি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে সরকার দ্রুতই এ বিষয়ে একটা ব্যাখ্যা দেবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)