কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছিল পুরো বাংলাদেশ। অন্য অনেকের মতো সেদিন কেঁদেছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোবাশ্বের হাসান সিজার । ৭ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগেও ফেসবুক পোস্টে তিনি সেই কষ্টের কথা আরো একবার জানিয়েছিলেন। আজ হুমায়ূনভক্তরা যখন ১৩ নভেম্বর নন্দিত ওই কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সিজার তখন নিখোঁজ। তার জন্য কাঁদছে তার কন্যা, তার মা-বাবা-বোনসহ স্বজন ও বন্ধুকূল।
নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে বিবিসি’র একটি লেখা শেয়ার করে সিজার লিখেছিলেন, আমি প্রতিদিন তাকে মিস করি। তিনি আমাদের একজন আত্মীয়র মতো ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় বসে যখন আমার খুব কাছের ওই মানুষটির মৃত্যু সংবাদ শুনলাম, তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদেছিলাম।
এরপর তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের মতো আর কোনো লেখক ছিল না, আর হবেও না। সাবির মুস্তাফার লেখাটি শেয়ার করে তার প্রশংসা করে তিনি লিখেছিলেন, ২০১২ সাল থেকে প্রায়ই আমি লেখাটি পড়েছি।
বিবিসিতে প্রকাশিত সাবির মুস্তাফার সেই লেখাটিতে উঠে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন দিক। হুমায়ূন আহমেদ ৬৪ বছর বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাংলাদেশের এই সেরা গল্পলেখক দেশের সব তরুণ-তরুণীদের আদর্শ ছিলেন যারা ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের দিকে জন্মেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মজার বিষয় হলো সেখানে যে হুমায়ূন কখনো লেখক হতে চাইতেন না। তবে হুমায়ূনই সেই ধারাকে ভেঙেছেন যে বিজ্ঞান পড়লে সাহিত্যে পদচারণা করা যায় না। তাই তিনি বলতেন, বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করে ক’জন লেখক হতে পারেন! আপনি কী পড়ছেন এবং পরবর্তীতে আপনি কী হবেন সেটার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উপন্যাস ও ছোট গল্পের পাশাপাশি টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখেছেন তিনি এবং সেই সব গল্পের ভিত্তিতে নাটকও পরিচালনা করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা কিছু কিছু চরিত্র জীবনের থেকেও বড় হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত জীবনের উত্থান পতন খুবই মজা করে উপস্থাপন করেছেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদকে বাংলা ভাষায় শতাব্দীর সেরা লেখক হিসেবে উল্লেখ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সাবির মুস্তাফা সেখানে লিখেছিলেন: ৭০ এর দশকেও বাংলাদেশের বই বাজারে আধিপত্য ছিলো বিদেশি লেখকদের। সেই ধারা একা হাতে ভেঙে দেন হুমায়ূন আর প্রকাশনা বাজারে প্রাণ সঞ্চার করেন। তার উপন্যাস যুবকদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের। তার লেখা নাটকগুলো টিভিতে তুলে ধরায় সেটার জনপ্রিয়তা আরো ছড়ায়।
১৯৮০র দশকে তিনি শুধু বাংলাদেশের বেস্টসেলার লেখক ছিলেন না, বরং টিভির একটি ভালো সম্পদও ছিলেন তিনি। তার সুনাম পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ছড়িয়ে পড়ে।
তার সৃষ্টির জন্য প্রায়শই সমস্যায় পড়তেন হুমায়ূন। এক বোকা সোকা গৃহকর্মী কাদেরের চরিত্র নিয়ে ঝামেলা তৈরি করে কিছু ইসলামী সংগঠন। কাদের সৈয়দ পরিবারের ছিল, আর বাংলাদেশে অনেক মানুষ বিশ্বাস করে সৈয়দরা হলো নবীর উত্তরপুরষ।
বহুব্রীহি নাটকে একজন ডাক্তারকে বোকা সোকা প্রেমিক পুরুষ হিসেবে দেখানো হয়। সেটা নিয়েও অনেক ডাক্তার বিরোধিতা শুরু করেন। তারা গভীরভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতিও দেন।
বাকের ভাই হুমায়ূন সৃষ্ট আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম। সবখানে অন্যদের সাহায্য করার গুণের কারণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিল বাকের ভাই। কিন্তু কোথাও কেউ নেই নাটকে হত্যার জন্য ভুলভাবে মৃত্যুদণ্ড পান তিনি। সেটা সারাদেশের মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। চিঠিতো বটেই, গণস্বাক্ষরও সংগ্রহ করা হয় বাকের ভাইকে না মারার জন্য। কিন্তু হুমায়ূন তার গল্পের ধারাতেই ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়।
এরও অনেক বছর পরও কাল্পনিক এই চরিত্রের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে তার জন্য দোয়া করা হতো। বাকের ভাইকে নিয়ে এই ধরনের ঘটনায় খুবই বিচলিত ছিলেন হুমায়ূন নিজেও। তিনি বলতেন, কত কত মানুষ কোন কারণ ছাড়াই ফাঁসিতে ঝুলে, কত মানুষ রাস্তার ধারে মরে থাকে সেগুলো নিয়ে মানুষের কোন মাথাব্যথা নেই। আর একটি কাল্পনিক চরিত্রের মৃত্যুতে মানুষ এভাবে হাত উঠিয়ে বসে আছে।
অবশ্য বিতর্কের উর্ধ্বে ছিলেন না হুমায়ূন। ৩০ বছরের বিবাহিত সম্পর্ক ভেঙে পুনরায় বিয়ে করায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তবে এরপরও তার জনপ্রিয়তায় খুব একটা ভাটা পড়েনি বলে বিবিসি’র ওই লেখায় মন্তব্য করা হয়।
হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর পরে দেশের সব মানুষের এক কাতারে আসাটাও তার প্রতি ভালোবাসাই প্রকাশ করে। তখন এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার মৃত্যু জাতির একটি অপূরণীয় ক্ষতি। আর তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেন, তার মৃত্যু বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বড় শূন্যতা তৈরি করবে যা সহজে পূরণ হবার নয়।
বিবিসিতে প্রকাশিত সাবির মুস্তাফার লেখাটি সিজার খুব পছন্দ করেছিলেন, কারণ তিনিও সেভাবেই দেখেন হুমায়ূন আহমেদকে।