সফল বিপ্লবে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিদ্রোহী সরকার, বিভিন্ন সশস্ত্র দল, জাতিভিত্তিক বাহিনী, দলত্যাগী এক জেনারেলকে নিয়ে চরমভাবে বিভক্ত লিবিয়া। সুসময়ের আশায় আচ্ছন্ন লিবিয়াবাসীর তুমুল জাগরণের পর এমন বিভক্তি, সংঘাত নিয়ে কি ভাবছে লিবিয়াবাসী? গাদ্দাফির করুণ পরিণতির জন্য কি তারা অনুতপ্ত?
গাদ্দাফি আমলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া কয়েকজনের সাথে কথা বলে প্রতিবেদন করেছে আল-জাজিরা।
১৯৬৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪২ বছর লিবিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। আরব বসন্তে আন্দোলিত হয়েছিলো লিবিয়াও, ব্যাপক জাগরণ, বিপ্লবের পর সির্তে শহরে এক হামলায় ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর মারা যান গাদ্দাফি।
লিবিয়ার ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহী গ্রুপ এখন অসংখ্য ভাগে বিভক্ত। নিজ শহরের প্রতি অনুগত থেকে, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে বা বিদেশী সমর্থকদের আনুকূল্যে বিভক্ত এই সশস্ত্র বিদ্রোহীরা।
এই সংঘাতের ফলে এখন পর্যন্ত মারা গেছে হাজারো যোদ্ধা, বেসামরিক লোকজন। দেশটির আর্থিক অগ্রগতি এখন শ্লথ। সেখানে ইসলামিক স্টেট বা অন্যান্য জঙ্গি দলগুলোর জন্য অনুকূল পরিবেশ।
মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো লিবিয়ার এই জটিল সংঘাতময় পরিস্থিতিতে গভীরভাবে জড়িয়েছে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের আর্মি প্রধান জেনারেল হাফতারের সমর্থনে প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালাচ্ছে দেশদুটি।
গাদ্দাফির আমলে সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হাফতার। ২০১৪ সালে হাফতারের স্বঘোষিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) বেনগাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই শুরু করার পর সফল হয়। ত্রিপোলিভিত্তিক লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের বিপক্ষে দাড়ায় তারা।
লিবিয়ার এই পতনে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, গাদ্দাফির শাসনের সময়েই কি ভালো ছিলো লিবিয়া?
তবে এ ব্যাপারে কোন সংশয় নেই এক অংশের। তারা হলেন গাদ্দাফির শাসনামলে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষগুলো। গাদ্দাফির মৃত্যুতে অনুতাপের চিহ্ন নেই তাদের মধ্যে।
‘ব্রাদার লিডার’ গাদ্দাফির সময় ভিন্নমতাবলম্বীদের কোন স্থান ছিলো না। বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের পরিণতি ছিলো কারাদণ্ড বা মৃত্যু বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া।
দমন পীড়নের কারণে সেসময় হাজারো লিবিয়ান দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, এদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য, বামপন্থীরা। এদের অধিকাংশই দশকের পর দশক নির্বাসনে কাটিয়েছেন। দেশে ফেরার কোন প্রত্যাশাও তাদের ছিলো না। তবে ২০১১ সালের বিপ্লব তাদের আশাবাদী করে, বিপ্লবে অংশ নিতে তখন দেশে ফিরেছিলেন হাজারো মানুষ।
২০১১ সালের সেই জাগরণে অংশ নেন লিবিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক বেলাল বেলালি। লিবিয়ান সরকার বেলালির বাবাকে ওয়ান্টেড লিস্টে রাখলে বেলালিসহ তার পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর স্কটল্যান্ড ও বার্মিহামে ৩২ বছর কাটে তাদের নির্বাসিত জীবন। কিন্তু বিপ্লবে অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন এই অনুসন্ধানী গবেষক, “আলহামদুলিল্লাহ, আমি সুযোগ পেয়েছিলাম তাতে অংশ নেওয়ার।”
নির্বাসনকালীন সময় বেলালি ভাবতেই পারেননি এই শাসন ব্যবস্থা কখনো শেষ হবে। কিন্তু ২০১০ সালের আরব বসন্ত সময় তাকে আশাবাদী করে।
তিনি বলেন, “তিউনিসিয়া ও মিশরে যা হয়েছিলো, লিবিয়াতেও সেরকম কিছুর স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু বাস্তবতা হলো গাদ্দাফির নির্মমতা, তিনি যেভাবে বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করেন, তাতে আমি ভাবতেই পারিনি তা কখনো বাস্তবায়িত হবে।” কিন্তু তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
লিবিয়ায় বিপ্লবের পর ন্যাটো নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার ফলে মাত্র ৬ মাসের মাথায় রাজধানী ত্রিপোলি বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। গাদ্দাফি তার শক্তঘাটি সির্তেতে পালিয়ে যান। কিন্তু বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে ও ন্যাটোর বিমান হামলার মুখে পালাতে গিয়ে ধরা পরে নিহত হন।
“আমি ভেবেছিলাম এটাই যুদ্ধের শেষ, আর কোন রক্তপাত হবে না এবং ভবিষ্যতের আশায় উদ্বেলিত হয়েছিলাম।” কিন্তু বেলালির সেই আশা এখনও দুরাশা।
গাদ্দাফির মৃত্যুর পর বেলালি আশাবাদী হয়েছিলেন কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই লিবিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ভেঙ্গে যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র আসে এখানে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে চাকরীর আশাহীন তরুণদেরও সংখ্যাও বাড়ে।
বিলালি বলেন, “এই বিভক্তি ও সংঘাত গাদ্দাফির মৃত্যুর বা সফল বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ ফল নয়। জেনারেল খলিফা হাফতার যখন ত্রিপোলিতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটায়, বেনগাজিতে যুদ্ধ শুরু করে তখনই লিবিয়ার পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হওয়া শুরু করে।” জেনারেল হাফতারের উচ্চাকাঙ্খাকে দায়ী করেন তিনি।
বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত লিবিয়ানদের মনও এমন গল্প-আবেগে পূর্ণ। গাদ্দাফি প্রশাসনের ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে ১৯৯৯ সালে পরিবারসহ ম্যানচেস্টারে পালিয়ে আসেন মোহাম্মদ মুখতার। ২০১১ এর বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন এই সাবেক বিদ্রোহী।
তবে তিনি অবশ্য আরও আগে থেকেই আশাবাদী ছিলেন, নিশ্চিত ছিলেন গাদ্দাফির পতনের ব্যাপারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমি এমন পরিবেশে বড় হয়েছি যা গাদ্দাফীর তীব্র বিরোধী ছিলো, লন্ডনে সেই শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সবসময় অংশ নিয়েছি।
“লিবিয়া আমার চিরন্তন ঘর। আমাদের মানুষদের বিরুদ্ধে দমন আমাকে আলোড়িত করতো। আমি মহৎ লক্ষ্য অর্জন করতে চাইতাম, তোমার মানুষের মুক্ত করার চেয়ে মগৎ আর কি হতে পারে?”
বিলালের মতো মুখতারও লিবিয়ার সঙ্কটের জন্য রাজনীতিবিদদের ‘লোভী’ আকাঙ্ক্ষা এবং গণতন্ত্রে উত্তোরণ ঘটাতে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপকে দায়ী করেন।
“যারা মনে করে গাদ্দাফির শাসন ভালো ছিলো, তারা যদি এক মাসের জন্য হলেও গাদ্দাফি শাসনের অধীনে থাকতো, আমি শতভাগ নিশ্চিত তারা তাদের দাবি বদলে ফেলতো।” বলেন মুখতার।
এই সঙ্কটের সমাধান গাদ্দাফির শাসনে ফিরে যাওয়া নয়, বরং আমরা কেন বিপ্লব করেছিলাম তা স্মরণ করতে বলেন তিনি।
“আমি বিশ্বাস করি বিপ্লব সফল, যদিও নষ্ট দাঁত তুলে ফেললে ব্যথাতো হবেই।”