আমি আজ এক মহান বীরের কথা তুলে ধরতে চাই। নীরবে নিভৃতে অভিমানে অবহেলায় গতকাল যার জীবনের শেষ প্রদীপ নিভে গেছে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ আহমেদ। আবু সাঈদ ভাই ছিলেন চির সংগ্রামী একজন আপোষহীন মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল তাহেরের অনুজ। কর্নেল তাহেরর পরিবারের পাঁচ ভাই ও দুই বোন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একটি পরিবার এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য এ এক বিরল দৃষ্টান্ত।
১১ নং সেক্টরেই সাঈদ ভাই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তিনি একজন কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর পর্ব রাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য তিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ চরমসংকটে নিপতিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্সের শক্তি দিশেহারা হয়ে যায়।
একজন নিভৃতচারী সাঈদ ভাই শহীদ কাজী আরিফের অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান। তার এই প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার মেজর(অব.) জিয়া উদ্দীন।
১৯৭৯-৮০ সালে সামরিক শাসক পাতানো সামরিক কুদেতার মাধ্যমে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করতে থাকলে সাঈদ ভাইয়ের এই উদ্যোগ প্রতিরোধে রূপ নেয়।
কিন্তু সাঈদ ভাই ছিলেন বরাবরই নেপথ্য নায়ক। আমার খুব মনে পড়ে, ১৯৭৭ সালে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ মাহফিলে যারা সমবেত হয়েছিলেন তাদের সবাইকে সামরিক বাহিনী ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু সাঈদ ভাই ছিলেন নির্ভীক এক ব্যক্তি। তিনি সেনা সদস্যদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ওিই মিলাদ মাহফিল সম্পন্ন করেন।
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে আওয়ামী লীগ এবং জাসদের মধ্যে পুনঃঐক্য স্থাপনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এরপর খুনী জিয়া খুন হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে। পরিকল্পিত উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় অগনিত কর্মকর্তা ও সেপাহিদের। এই সমস্ত কর্মকান্ড এরশাদের অদৃশ্য ইঙ্গিতে পরিচারিত হয়।
১৯৮২ সালের মার্চ মাসে জেনারেল এরশাদ প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। শুরু হয় আন্দেলনের নতুন অভিযাত্রা। মেজর জিয়া উদ্দীন ও আবু সাঈদ আহমেদ মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ নামে যে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, কাজী আরিফ আহমেদের অনুপ্রেরণায় তা অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দেলনে বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
১৯৮২-৯০ পর্যন্ত সামরিক শাসন বিরোধী আন্দেলনে মরহুম সাঈদ ভাই এক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে তা নতুন প্রজন্মের জানবার কথা নয়। কোথায় ছিল না তার পদচারনা? বাসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও তার অবাধ যাতায়াত ছিল ধানমন্ডী-৩২ এ, পুরানা পলা্টনে সিপিবিরি কার্যালয়ে, বাসদ কার্যালয়ে, ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ে। অর্থাৎ সারাদিন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে, যাতে কোন বিভক্তির ছেদ না পড়ে।
আন্দোলনের সময় কোন সংকট তৈরি হলেই তিনি পায়ে হেটে বা রিক্সায় চলে আসতেন মধুর ক্যান্টিনে। কখনো কখনো সন্ধ্যায় চলে আসতেন টিএসসিতে। তার সাদামাটা জীবনে এককাপ চা আর স্টার সিগিারেট ছিল তার নিত্য সঙ্গী। তিনি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মতো জীবন যাপন করতেন।
এরশাদের পতনের পর খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে ৭১’র যুদ্ধাপরাধী ঘাতক গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রাথমিক যে বিস্ফোরণ হয় তারও অনুঘটক ছিলেন সাঈদ ভাই। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত গণ আদােলতে সাঈদ ভাইয়ের কি ভূমিকা ছিল তা ওই আন্দোলনে সক্রিয় সকল নেতাকর্মী অবগত আছেন।
জাসদ নেতা কাজী আরিফের হত্যাকাণ্ডের পর সাঈদ ভাই অনেকটা নির্লিপ্ত হয়ে পড়েন। তার এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেটি হঠাৎ দুঃখজনকভাবে পােনিতে ডুবে মারা যাওয়ার পর সাঈদ ভাই সামাজিক দৃশ্যপট থেকে নিজেকে একবারে আড়াল করে ফেলেন।
সাঈদ ভাইয়ের এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার সংগ্রামী জীবনের সমস্ত ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা উচিত। কিন্তু এই পরিসরে তা সম্ভব না বলে পরবর্তীতে নতুন প্রজন্মের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের স্মৃতিগুলি সংকলিত করে তুলে ধরা যায়।
তবে শেষ কথায় বলতে চাই মুক্তিযুদ্ধের ধারায় আজকের যে বাংলাদেশ সেই বাংলাদেশে সাঈদ ভাই রেখে গেছেন তার বিপ্লবী পদচিহ্ন। শান্তিতে থাকুন না সাঈদ ভাই। আমরা আপনার ঋণ শোধ করতে পারবো না। আমরা চির ঋণীই রয়ে গেলাম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)