আগরতলার নাম শোনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমরা ছোটবেলায় প্রবাদ শুনেছি, ‘কোথায় আগরতলা, আর কোথায় চোকির তলা!’ এই প্রবাদের মধ্যদিয়েও কিন্তু আগরতলার শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রকাশ করা হতো। বহু কারণে আগরতলা বিখ্যাত। সবেচেয়ে বেশি বিখ্যাত সম্ভবত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে দায়ের করা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র কারণে! মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের আগরতলায় আশ্রয় নেওয়া, সেখান থেকে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্মৃতিও আগরতলাকে বাঙালির হৃদয়ের আসনে ঠাঁই দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হোসাইন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা) এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, আগরতলা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। অর্থাৎ আগরতলা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের অতি-কাছের এই ঐতিহাসিক স্থানটি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি আমার এক সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী (বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সরদার রুহিন হোসেন) প্রিন্স ভাই আগরতলা সফরে যান। সফরে গিয়ে প্রিন্স ভাই ও কাকলী আপা (প্রিন্স ভাইয়ের জীবন-সঙ্গিনী) আগরতলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের ছবি দেন। ফেসবুকের সুবাদে সেইসব আকর্ষণীয় ছবি দেখে আবারও আগরতলা যাবার আগ্রহটা দানা বেঁধে ওঠে। এর মধ্যেই বন্ধু তাহমিদ প্রস্তাব করে এই ডিসেম্বরেই আগরতলা সফরের। আমাদের আরেক বন্ধু বুলবুলও প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। আমরা তিন পরিবারের মোট নয় সদস্য ভিসা যোগাড় করে গত ৮ ডিসেম্বর ভোরে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। একটি মাইক্রোবাসে করে আমরা প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া স্থল বন্দরে পৌঁছাই। সেখানে উভয় দেশের সীমান্ত চেকপোস্টের নিয়মাবলি মেনে আগরতলা প্রবেশ করি।
প্রিন্স ভাইয়ের মাধ্যমে আগরতলার এক যুবনেতা বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এই ভ্রমণের উদ্যোক্তা তাহমিদ আগরতলা নিবাসী বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের আবাসন ও স্থানীয় পরিবহনের ব্যবস্থা করে। দুপুর দেড়টায় আগরতলা শুল্কবন্দর পেরিয়েই দেখি দুইটি ছোট ছোট মাইক্রোবাস নিয়ে বিক্রম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা ভাগাভাগি করে দুই মাইক্রোতে উঠে বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই শহীদ ভগৎ সিং যুব আবাসে। এটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। এর এক পাশে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সোনারতরী, আরেক পাশে ত্রিপুরার সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেল জিঞ্জারের অবস্থান। আমরা হোটেলে যাওয়ার পথেই চোখে পড়ল একটি উড়াল সেতু। এটাই আগরতলার প্রথম উড়াল সেতু। এখনও কাজ শেষ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানলাম, উমাকান্ত একাডেমি থেকে ত্রিপুরা দূর্দশন কেন্দ্র পর্যন্ত ২.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নির্মিয়মান উড়াল সেতুটি যুক্ত হবে ভারতের ৪৪নং জাতীয় মহাসড়কে।
আমরা হোটেলে পৌঁছে হাতমুখ ধুয়েই বেরিয়ে পড়ি। চলে যাই এক মাড়োয়ারি হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে। ভরপেট খেয়ে বিক্রমের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করি দূরবর্তী এক গ্রামে। যেখানে বাঁশ থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরির এক কারখানা রয়েছে।
প্রযুক্তি আর সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বাঁশ প্রসেসিং করে এখানে তৈরি করা হচ্ছে কাঠের বিকল্প বাঁশকাঠ বা ব্যাম্বোউড। আর সেই কাঠেই সাজছে ঘরে দরজা, জানালা, আসবাব, টাইলসের বিকল্প হিসেবে মেঝে, সিলিং থেকে একটি ঘরে যা যা লাগে তার সব। যা নান্দনিকতার পাশপাশি পরিবেশবান্ধব ও ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতে পারে।
তিন হাজার টনের চাপে সলিড কাঠে পরিণত হচ্ছে বাঁশ। দেখতে অবিকল কাঠের মতো, কিন্তু দ্বিগুণ চাপ নিতে সক্ষম ‘ব্যাম্বোউড’। ‘এপিটম’ ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করে বাঁশকাঠ থেকে তৈরি আসবাবসহ বিভিন্ন জিনিস এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি।
আমরা পুরো কারকানাটি ঘুরে দেখি আর মুগ্ধ হই। বাঁশ থেকে এমন অসাধারণ সব আসবাব তৈরি করা যায়, নিজের চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। কারখানার ম্যানেজার আমাদের জানান, চৌদ্দ মিলিমিটার পুরু একটি কাঠের তক্তা সর্বোচ্চ ৬শ কেজি লোড নিতে পারে। সেখানে বাঁশকাঠ ১২শ কেজি লোড নিতে সক্ষম। কাঠে ধাতব পদার্থ দিয়ে আঁচড় লাগলে সহজেই স্ক্রাচ বা দাগ পড়ে যায়, কিন্তু বাঁশকাঠে এই আশঙ্কা নেই।
কাঠের টেবিলে অসাবধানতাবশত আগুন পড়লে দাগ বসে যায়। কিন্তু এতে সেটা হবে না। সাধারণত কাঠ আগুনের সংস্পর্শে এলে ৭ মিনিটের মাথায় জ্বলতে শুরু করে, হাইড্রোলিক চাপে প্রস্তুত ‘এপিটম ব্যাম্বুউড’ ১৬ মিনিট পর্যন্ত থাকে নিরাপদ। কাঠে ঘুনপোকাসহ নানারকম কীটের আক্রমণ হয়, বাঁশকাঠ এখানেও সেরা। কীটের আক্রমণের আশঙ্কা নেই। আবার স্থায়ীত্ব কাঠের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
ভারতবর্ষে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবনী ইকো ফ্রেন্ডলি এ কাজটি করেছে মুম্বাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মুথা গ্রুপ। দেশটির শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে থাকা রাজ্য ত্রিপুরার শিল্পনগরীতে কারখানা গড়ে উৎপাদন হচ্ছে নান্দনিক টেকসই এ কাঠ।
এই কারখানা পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যার মায়াবি আলোয় রাবার বাগানের ভেতর দিয়ে আমরা শহরে ফিরে আসি। ত্রিপুরা রাজ্যের সবুজের মায়াতে আমরা মুগ্ধ। ত্রিপুরার বিল, বন, নদী আর নীরবতা আমাদের ভ্রমণে অন্যরকম স্বাদ জোগায়। এখানে শহর ছেড়ে একটু দূরে গেলেই পাওয়া যায় প্রশান্তির সবুজের আচঁল। ছায়াশীতল প্রান্তীয় জনপদের শান্তশ্রী লোকালয়গুলি সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষ্য বহন করে বড় উজ্জ্বল হয়ে মিশে আছে আধুনিক ত্রিপুরার সর্বাঙ্গীন জনজীবনে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরণের ব্যতিক্রমী চালচিত্রে নিজেকে ধরে রেখেছে আজকের ত্রিপুরা।
দশ হাজার চৌদ্দ বর্গকিলোমিটার আয়তন। ৯৫ ভাগ বাংলা ভাষাভাষীর আঞ্চলিক উচ্চারণে সমৃদ্ধ ৩৯ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত সাড়ে তিন দিক বাংলাদেশ ঘেরা ইতিহাস ঐতিহ্যের রাজ্য ত্রিপুরা। ভারতের এই ক্ষুদ্র রাজ্যটির নামকরণ জড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের সময় কাল থেকে। বলা হয়ে থাকে ভূমি অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর নামানুসারে এর নামকরণ। এ ছাড়া রাজ্যের আদিবাসীদের ককবরক ভাষা থেকেও ত্রিপুরা নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
পৌরাণিক রাজা ত্রিপুরের নামানুসারে বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের নামকরণ হয়েছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। এই রাজ্যের রাজত্বকালের রয়েছে আড়াই হাজার বছরের ১৮৬ রাজা-রানীর রাজ্য শাসনের ইতিহাস। ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার মাণিক্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশের পরম্পরায় রাজদণ্ড তাঁদের হাতেই ছিল। ১৮৭১ সালে ত্রিপুরায় প্রথম হাত দেয় ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালে মাণিক্যবংশের শেষ রাজা বীরবিক্রম কিশোর মারা যাওয়ার পর, রাজমাতা কাঞ্চনপ্রভা দেবী ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে ১৯৪৯ সালে ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের অধীনে চলে আসে। ১৯৭২ সালে ত্রিপুরা আলাদা অঙ্গরাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ত্রিপুরার সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটা বিশেষ নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সেই ছাপ পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে।
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর নৈসর্গিক সৌন্দয্যের লীলাভূমি এই রাজত্বে পর্যটকদের দুর্বার আকর্ষণ এক অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে। প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রত্নতত্ব নিদর্শনস্থল ও মন্দির, সমৃদ্ধ অভয়ারণ্য-ইকো পার্ক ও প্রাচীন রাজধানীর ধ্বংসাবশেষগুলোকে ঘিরে পর্যটকদের উপস্থিতি এ অঞ্চলকে করেছে সরগরম।
পরদিন সকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা যাই খোয়াই জেলার কল্যাণপুর ব্লকের দ্বারিকাপুর চা-বাগানে। বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে অবিরাম বৃষ্টিতে আমাদের ভ্রমণ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয় বটে, কিন্তু আমরা অবিচল। বৃষ্টির মধ্যেই চলে আমাদের ঘোরাঘুরি। চা-বাগান দেখে সোজা রওনা হই আগরতলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান নীরমহলের উদ্দেশ্যে।
মেলাঘর নামক স্থানে অবস্থিত ত্রিপুরার একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক দর্শনীয় স্থান নীরমহল। নীর অর্থাৎ জলের মাঝখানে মহল হওয়ায় এর নামকরণ হয় নীরমহল। ইংরেজিতে ওয়াটার প্যালেস। আগরতলা থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে মহারাজার অবসর বিনোদনের এই মহলটি এখন পর্যটকদের আকর্ষণের মূলকেন্দ্র। ১৯৩০ সালে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মানিক্যের আমলে নির্মিত প্রাচীন স্থাপত্যের এক অসাধারণ নিদর্শন। প্রাসাদটিতে ত্রিপুরার ঐতিহ্য মাথায় রেখে হিন্দু ও মুসলিম উভয় স্থাপত্যেরই ছোঁয়া রয়েছে। বিশাল প্রাসাদকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ৫,৩০০ কিলোমিটারের এক হ্রদ। এই হ্রদের নাম রুদ্রসাগর। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে (সাগরমহল ট্যুরিস্ট লজের প্রান্তে) নিয়মিত মোটরবোট চলাচল করে নীরমহল পর্যন্ত, সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি। ভাড়া মাথাপিছু ১০ টাকা। সপ্তাহের প্রতি দিনই খোলা থাকে নীরমহল। ভূ-ভাগ থেকে দশ মিনিটে আমরা মহলে পৌঁছে যাই। ৪০ মিনিট মহলে থাকা যায়। অতিরিক্ত সময়ের জন্য আলাদা ফি দিতে হয়।
পুরো মহলটি ঘুরে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের আমলে অনিন্দ্য সুন্দর এই মহলটি তৈরি করা হয়। ইংল্যান্ডের মার্টিন এন্ড বার্ন কোম্পানি ১৯৩০ সালে কাজ শুরু করে ১৯৩৮ সালে প্রাসাদটির কাজ সম্পন্ন করেন। রুদ্র সাগর হ্রদের ঠিক মাঝখানে ত্রিপুরা রাজার গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের দুটি অংশ। মূল অংশ পশ্চিম পাশে এবং পূর্বে নিরাপত্তাবাহিনীর দুর্গ। মহলের ভেতর বিশ্রাম ঘর, খাজাঞ্চিখানা ও নাচঘরসহ ৫টি বড় কক্ষ। দাবা খেলার আলাদা কক্ষ এবং রানী ও অন্যদের জন্য অন্দর মহলে ৬টি বড় কক্ষ দেখলাম। এর বাইরে আড্ডা ঘর, সভা ঘর ও রান্না ঘরতো রয়েছেই। প্রাসাদের ভেতর একটি বাগানও রয়েছে।
রাজা-রানী হ্রদে বেড়ানোর জন্য মোটর চালিত নৌকা ব্যবহার করতেন। মহলটি এমনভাবে তৈরি বেড়ানো শেষে অন্দর মহলের সিঁড়ি পযন্ত সরাসরি নৌকা চলে আসতো। প্রাসাদের বাইরের দিকে দুটি ঘাট যেখানে কর্মচারীরা স্নান করত। মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর মাত্র সাত বছর এটি ব্যবহার করতে পেরেছেন। কারণ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে রাজার অকাল মৃত্যু হয়। বর্তমানে রাজপ্রাসাদটি ত্রিপুরার তথ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের অধীন একটি আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মেলাঘর-এ বড় একটি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
নীরমহলে আসা যাওয়ার পথে পড়ে একাধিক ইকোপার্ক। কিন্তু বৃষ্টির কারণে আমরা সেসব স্থানে নামতে পারিনি।
তৃতীয় দিন সকালে আমরা প্রথমেই যাই ত্রিপুরা রাজার প্যালেস (রাজ প্রাসাদ) দেখতে। ২০ একর জমির ওপর শ্বেত শুভ্র রাজবাড়ি। এটির নাম উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। ভেতরে দুটি বড় দিঘি রয়েছে। খুবই সুন্দর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাজ প্রাসাদ। সামনে ফুলের বাগান, পাশেই জগন্নাথ মন্দির। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগরতলা আসলে কুঞ্জবন বিহারে থাকতেন, এখন এটি রাজ্যপালের আবাসস্থল।
জানা যায়, একশ ষোল বছরের পুরোনো এই প্যালেস। ১৯০১ সালে তৎকালীন রাজা রাধা কিশোর মানিক্য এটি তৈরি করেন। এই প্রাসাদ দেখে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের লেখা বিসর্জন নাটকটির মূল চরিত্র মহারাজা গোবিন্দমানিক্যের কথা। ত্রিপুরার এই প্রজাবৎসল রাজার মুখ দিয়েই আমরা সেই বিখ্যাত সংলাপটা শুনতে পাই, এত রক্ত কেন, এত ব্যথা কেন? কে বলিয়া দিবে মোরে? রাজার রাজ্য সভার ৬০ সদস্যের রাজ্যপর্ষদ বিধায়ক, দুই সদস্যের নির্বাচিত লোকসভা সদস্যগণের অধিবেশনে কার্যক্রম পরিচালিত হতো এই ভবনে। তবে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে। ভবনটির প্রভূত সংস্কারের পর ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে দর্শনার্থীর জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধে পরিদর্শন পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
এরপর আমাদের গন্তব্য হেরিটেজ পার্ক। ত্রিপুরা রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী ও দর্শনীয় সকল স্থাপনাগুলোর হুবহু নকল করে রাজ্যের রাজধানী আগরতলার মালঞ্চনিবাস এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে হেরিটেজ পার্ক। আগরতলা শহর থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই দর্শনার্থীরা পৌঁছে যাবেন হেরিটেজ পার্কে। মাত্র ১০ রুপি দিয়ে প্রবেশ করেই উপভোগ করা যায় ছায়া-সুনিবিড় আর সবুজে ঘেরা হেরিটেজ পার্কের অপরূপ সৌন্দর্য। পুরো ত্রিপুরা রাজ্যের ঐতিহ্য আর দর্শনীয় স্থানগুলোকে এক নিমেষেই দেখে নেওয়া যায়।
এরপর আমরা যাই ত্রিপুরার সরকারি যাদুঘরে। ত্রিপুরার সরকারি জাদুঘর হলো একটি সংগ্রহস্থল যেখানে হস্তনির্মিত এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে যা উত্তর-পূর্বের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। বস্তুত, এই যাদুঘটি রাজ্যের সাংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে গণ্য। ১৯৭০ সালের ২২ জুন এই জাদুঘর, উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন রয়েছে।
ত্রিপুরার সরকারি জাদুঘর হলো একটি সংগ্রহস্থল যেখানে বিশুদ্ধ চারু ও কারুশিল্প জড়িত সৌন্দর্যের অমূল্য টুকরো সংগৃহীত রয়েছে। জাদুঘরটি রাজধানী আগরতলার চোওমোহানি ডাকঘরের নিকটে অবস্থিত এবং চারটি গ্যালারির সমন্বয়ে গঠিত; এগুলো হলো-প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, উপজাতীয় সংস্কৃতি গ্যালারি, পেইন্টিং গ্যালারি, বিভিন্ন যুগের ভারতীয় ভাস্কর্য গ্যালারি।
গ্যালারিগুলিতে ১৬৪৫-এর বেশি বিস্ময়কর ঐতিহাসিক স্মারক রয়েছে। পণ্ডিত এবং ঐতিহাসিকদের দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে অনেক সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে যা সেই সময়ের মুদ্রাসংক্রান্ত প্রাগৈতিহাসিক গুরুত্বকে প্রমাণিত করে। অনেক মৃৎশিল্প টুকরো, ভাস্কর্য এবং পোড়ামাটি, ব্রোঞ্জ মূর্তি এবং আদিম তাম্র শিলালিপিও পাওয়া গিয়েছে। চমৎকার তৈল চিত্র, ছবি এবং অলঙ্করণ, বস্ত্র সেইসঙ্গে অলঙ্কার এখানকার গ্যালারিগুলিকে উজ্বল করেছে।
এই জাদুঘরের সংরক্ষণাগারে রয়েছে কিছু মূল্যবান পান্ডুলিপি যেগুলি বাংলা কাহিনি ও সংস্কৃত মহাকাব্যের অংশ। এর মধ্যে একটি লাইব্রেরি রয়েছে যেখান থেকে ত্রিপুরার ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, স্থাপত্য ও নৃবিদ্যা সম্বন্ধে জানতে পারা যায়। বিভিন্ন নথি থেকে জানা যায়, ত্রিপুরার জনসংখ্যার মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭০ শতাংশ হিন্দু, ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ মুসলিম, ১ দশমিক ৯০ শতাংশ বৌদ্ধ, ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ১ দশমিক ১৫ ধর্মাবলম্বী। রাজ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। অধিবাসীদের মধ্যে প্রধান ভাষা বাংলা। দাপ্তরিক কাজও হয় বাংলায়। পাশাপাশি আদিবাসীদের মধ্যে ত্রিপুরা ভাষা ককবরক প্রচলন বেশি।
বিভিন্ন জনের কথা বলে জানা যায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ত্রিপুরার মাহারাজাদের সম্পর্ক দীর্ঘ কালের। সেই যোগসূত্রকে স্থায়ী সুখ-দুঃখের সম্পর্কে নিবিড় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভিত্তিমূলে ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ত্রিপুরার মহারাজাদের অকৃত্তিম ভালোবাসা। বঙ্গেও যখন বাংলা ভাষার সরকারি মর্যাদা নেই, ফার্সি বা ইংরেজি যখন সবকিছুর ওপরে পা রেখে দাঁড়ানো, ত্রিপুরার রাজভাষা তখনও বাংলা!
এ এক বিস্ময়কর অতীত! ত্রিপুরার রাজপরিবার বাঙালি নয়, কিন্তু তাদের উদ্যোগেই রাখিবন্ধনে আবদ্ধ হয় ত্রিপুরা ও বাংলা। এই রাজ্যের মহারাজাদের হাতে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা যেমনি ইতিহাস, তেমনি ইতিহাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরবর্তী প্রজন্মের ত্রিপুরাবাসীর বিস্ময়কর পৃষ্ঠপোষকতা।
মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য থেকে ত্রিপুরার আধুনিক ইতিহাসের সূচনা। কিশোর রবীন্দ্রনাথকে, যার কাব্যখ্যাতি তখন কেবলই পরিচিতজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, সর্বপ্রথম ‘কবি’ হিসেবে স্বীকৃতিদান করেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়, ‘যে অপরিণত বয়স্ক কবির খ্যাতির পথ সম্পূর্ণ সংশয়সঙ্কুল ছিল, তার সঙ্গে কোন রাজত্ব গৌরবের অধিকারীর এমন অবারিত ও অহেতুক সখ্য-সম্বন্ধের বিবরণ সাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব।’
ত্রিপুরার মহারাজাদের হাতে বাঙালির ভাষাসংস্কৃতি, বিজ্ঞান যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে, তা বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথের বন্ধুজন জগদীশ চন্দ্র বসু বিলেতে গিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করবেন। তার অর্থ চাই প্রচুর। কবি স্বয়ং অর্থ সংগ্রহে নামলেন। কিন্তু তা দেখতে চাইলেন না মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্য। কবিগুরুকে তিনি লিখলেন: ‘এ বেশ আপনার সাজে না, আপনার বাঁশি বাজনাই কাজ, আমরা ভক্তবৃন্দ ভিক্ষার ঝুলি বহন করিব।’ চিঠির পরের অংশটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। রাধাকিশোর লিখলেন: ‘প্রজাবৃন্দের প্রদত্ত অর্থই আমার রাজভোগ যোগায়-আমাদের অপেক্ষা জগতে কে আর বড়ো ভিক্ষুক আছে।’
এই রাধাকিশোর মাণিক্যই সেকালে ৫০ হাজার টাকা জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনায় দান করেন; বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। শুধু তাই নয়, অন্ধ কবি হেমচন্দ্র এবং ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাদের জীবনের সঙ্কটতম মুহূর্তে ত্রিপুরার মহারাজাদের কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে সঙ্কটমুক্ত হন।
আমার কাছে মনে হয়েছে সেই রাজ-রাজরাদের মতো আগরতলার মানুষও যথেষ্ঠ অতিথি পরায়ন। কলকাতার বা পশ্চিম বঙ্গের মানুষের চেয়ে এরা বাংলাদেশিদের বেশি প্রিয়। এখানকার মানুষ কথা বলে ঢাকাইয়াদের মতো। আছে কুমিল্লার মানুষের ভাষার টানও। খাদ্যাভ্যাসও আমাদের মতই। ত্রিপুরার সমতল ভূমিতে ধান-গম উৎপন্ন হয়। পাহাড়ে জন্মে মশলা এবং ফল। ত্রিপুরার আবহাওয়াও আমাদের মতো।
এখানে গেলে বামশাসনের অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। শহর জুড়ে কাস্তে-হাতুড়িখচিত লাল পতাকা। প্রায় ২৪ বছর একনাগাড়ে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বেশ জনপ্রিয়। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র মুখ্যমন্ত্রী।সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। ভারতের একমাত্র রাজ্য ত্রিপুরা, যেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন বামফ্রন্ট থেকে। ১৯৯৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো ত্রিপুরা রাজ্যে দায়িত্বে নেয় বামফ্রন্ট। সেবার মুখ্যমন্ত্রী হন মানিক সরকার। এরপর ২০০৩ সালে পঞ্চম, ২০০৮ সালে ষষ্ঠ এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে সপ্তমবারের মতো ত্রিপুরার বিধান সভা নির্বাচনে মন্ত্রীসভা গঠন করে বামফ্রন্ট। এতে মানিক সরকার ১৯৯৮ সাল থেকে টানা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ত্রিপুরা রাজ্যে বামফ্রন্ট অর্থাৎ কমিউনিস্ট রাজনীতির আধিপত্য বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামেগঞ্জে এ দলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। পরের অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। একদা কংগ্রেস ও তৃণমূল সদস্যরা এখন দল পাল্টে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছে। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ধীরে ধীরে পোক্ত হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি বেশ জোরেশোরে বাম শিবিরে হানা দিতে পারে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
আমরা পুরো তিনদিন আগরতলায় কাটিয়েছি। সকাল থেকে রাত অব্দি ঘুরে ঘুরে ছোটখাট ছিমছাম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন শহরটিকে দেখেছি। উচ্চ অট্রালিকার ছোঁয়া পায়নি এখনো আগরতলার আকাশ।
এখানে রাস্তাঘাটে ভিড় থাকলেও সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে দেখলাম। গভীর রাত পর্যন্ত লোকজনের চলাচলে এতটুকু কমতি নেই। মানুষজন বেশ সহজ-সরল। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। যে যার অবস্থান নিয়ে সুখী এবং খুশি। নারী-পুরুষ নির্বিঘ্নে শহরে চলাচল করছে।
সুদূর প্রাচীন নয়, ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত ত্রিপুরা যুক্ত ছিল বাংলার সঙ্গে। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরাকে প্রাত্যহিক বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে গোমতী নদী। বঙ্গের হৃদয়ে চিরস্থায়ি আসন পেতেছেন ত্রিপুরার শচীন দেববর্মন। এই দুই জনপদের পাখি, বাতাস, সকাল, দুপুর, বিকেল ও রাত এক। আজ নতুন রাষ্ট্রের নতুন সীমানা হয়েছে। ভাগ হয়েছে দেহ। কিন্তু হৃদয়? তাও কি ভাগ করা গেছে? আমার বিশ্বাস, না!
ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ১৯৭১ এর রক্ত দিয়ে লেখা, যা ইতিহাসের অমোচনীয় অধ্যায়! তিন দিনে এতকিছু দেখেও অপূর্ণ রয়ে গেল অনেক কিছুই। যেমন, পিলাক-এর নবম শতাব্দীর বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মস্থানের ধ্বংসাবশেষ, বরানগরের বৌদ্ধস্তূপ, সাব্রুমের মহামুনি প্যাগোডা, অমরপুরের ডাম্বুর হ্রদ, বিলোনিয়ার কাছে কৃষ্ণা অভয়ারণ্য! ‘বাড়ির পাশের বিদেশ’ ঘুরে একটা অতৃপ্তি কিন্তু গভীর একটা প্রশান্তি নিয়ে আমরা আবারও সড়ক পথ ধরে ফিরে এলাম আমাদের নিজস্ব ডেরায়।
যারা ভবিষ্যতে ত্রিপুরা যাবেন তাদের জন্য কিছু টিপস: ১. খরচ করুন আর না করুন, পাসপোর্টে বাধ্যতামূলক ১৫০ ডলার এন্ডোস করে নিন। ২. ডলার যদি ভারতে অদল বদল করেন তবে রশিদ নিবেন। ৩. ত্রিপুরাতে সকল কিছুতে দামাদামী চলে। বাস ভাড়া থেকে হোটেল ভাড়া দামাদামী করুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।