গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনে রাষ্ট্রদূত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতার ছবি কৌশলে ইগ্নোর করেছিলেন। এ বছর কী দেখলাম? মুক্তাগাছায় পৌরসভার মেয়র শুধু নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে জাতির পিতার ছবি টানাননি। গোপালপুরের সেই মাদ্রাসা অধ্যক্ষের অবস্থা তো ছিল আরও ভয়াবহ। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের অনুষ্ঠানে তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বেহেশত পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে মোনাজাত করলেন।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিজয় র্যালি, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধীতাকারী খালেদা জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ৩০ লক্ষ শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ধর্ষণের কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রশ্ন হলো, উক্ত সব ঘটনা কি কোন অঘটন? উত্তর হচ্ছে: মোটেই না, এসব হচ্ছে চরম বাস্তবতা।
বিষয়টি আরও বিস্তারিত ভাবে বললে এমন দাঁড়ায়, আমাদের টকশোগুলোতে বিষয় প্রাসঙ্গিক, মুক্তিযুদ্ধ বা রাজাকার অথবা যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়ে ৫ মিনিট বললে সেটার কাউন্টার বক্তব্য শোনার জন্যও ৫ মিনিট সময় দিতেই হবে। যদি না দেয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র নাই ইত্যাদির।
বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীন বাংলাদেশ এনে দিয়ে গেছেন। অন্তত এই কথাটা বলা ও বিশ্বাস করতে আমার মিনিমাম কষ্ট লাগে না। আমি মোটেও লজ্জিত হই না, এজন্য যে- এখানে দিনকে দিন মুক্তিযুদ্ধকে এক ধরনের খেলনা ও হাসিখুশির গল্প বানানোর প্রজন্মের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে!
প্রশ্ন হচ্ছে, এই দায় কার? আমি মোটেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে দোষারোপ করি না। এই দায় আমাদের। এই দায় আমাদের সরকারের। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৯৬ পর্যন্ত দেশ কোন পথে ছিল, ওরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা ওটা দিয়ে দায় এড়ানো বা চাপিয়ে রাখা যাবে বলে মনে করছি না। কারণ গত ৪৬ বছরের বাংলাদেশ যদি ৩ স্টেপে ভাগ করেন, তাহলে বিষয়টা দাঁড়ায় এমন যে: ৭১ থেকে ৭৫, ৭৫ থেকে ৯১, ৯১ থেকে ২০০৮, এই তিন স্টেপের বাংলাদেশের নব জন্ম ২০০৯ সাল থেকে ধরলে আমি যদি আমার সফলতার মুকুটে অর্থনৈতিক বিপ্লব, রেমিটেন্স, অবকাঠামো উন্নয়ন, মাথা পিছু জিডিপি, পদ্মা সেতু, নাগরিক উন্নয়ন, দেশের ডিজিটালাইজেশন সহ পাকিস্তানকে টেক্কা দিয়ে দেশ এগিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন গল্প করি, তখন পাশাপাশি অবশ্যই আমাকে বলতে হবে এবং আমি বলতে বাধ্য, আমার মুক্তিযুদ্ধের মূল স্তম্ভগুলোর চর্চা কই?
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রাজাকারের পরিচিত, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, সংস্কৃতি বিপ্লব, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জুজু, আরও নানান মৌলিক বিষয়ে আমার অগ্রগতি কী? অবশ্যই আমাকে বলতে হবে আমার শিক্ষা ক্ষেত্রে কেন প্রগতিশীল লেখকদের লেখা আমি টিকিয়ে রাখতে পারিনি, কেন পারিনি সেই নার্সারী থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তরের পাঠ্য পুস্তকে জামায়াত একটি দেশ বিরোধী সংগঠন, তার দলের শীর্ষ নেতারা একাত্তরে অপকর্ম করেছে, জিয়াউর রহমান ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, জামায়াতের নেতাদের নাম উল্লেখ করে ওরা রাজাকার ছিল, পাকিস্তান জন্মগতভাবে আমাদের শত্রু রাষ্ট্র, এদের সমর্থন করা পাপ সহ আরো নানান ধরনের শব্দ চয়ন মগজে ঢুকিয়ে দিতে?
২০০৮ সাল থেকে এই ব্যর্থতা কার? ১৬ ডিসেম্বর ঈদ মোবারকের মত বিজয়ের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি, হিন্দি, উর্দু, আরবি গান বাজিয়ে বিজয় উদযাপন করেছি। ফেসবুকে রঙ-বেরঙের জামা কাপড়ের সেলফি দেখেছি। প্রশ্ন হচ্ছে অনেককে দেখিনি মুক্তিযুদ্ধের চার হিরো তৎকালীন প্রবাসী সরকারের চার বীরের নাম উল্লেখ করতে। জাতির পিতার প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানোর প্রয়োজন মনে করেনি অনেকে। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত নিয়ে তো আবার কনফিউশন আছে। আড়াই লাখ মা-বোনের কথা বাদই দিলাম। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবিদের কথা বলি কোন সাহসে?
যাই হোক, বিজয়ের ৪৬ বছরের বাস্তবতা এটাই। জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান কেন করা যাবে না, আদালতের রুল। অথচ আমরা একটি সৌদি আরব হতে প্রাণপণ লড়াই করছি, মোটেও ভিয়েতনামের মতো হতে নয়। এটাকে আফসোস বলবো? ব্যর্থতা বলবো কি না জানি না, তবে আমরা যেসব মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি, এই বাংলাদেশ সেই পথে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও এই যদি হয় চিত্র, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসলে তাদের কাছে আমরা কী কী প্রত্যাশা করবো? প্লিজ, কেউ কি বলতে পারবেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)