চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মিয়ানমার ইস্যুতে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন সুর

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্মী বাহিনীর জাতিগত নিধনের একবারে শুরু থেকে দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস পার হলেও ভারত, চীন এবং রাশিয়া মিয়ানমার সরকারকে নির্লজ্জ সমর্থন দিয়ে আসছে। প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে ভরপুর রাখাইনে নিজেদের প্রকল্প এবং আঞ্চলিক স্বার্থে তারা এই মানবিক সংকটেও অমানবিকতার পরিচয় দিয়ে আসছে। এমনকি তাদের মিয়ানমারপ্রীতি এতটাই ছিল যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠকসহ বিভিন্ন ফোরামে তাদের ‘ভেটো’র কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিক্রম ছিল। এই সংকটের শুরু থেকেই অমানবিকতার বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ছিল সোচ্চার। বর্মী জেনারেলদের চালানো জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বেশ কয়েকবার বিবৃতি দিয়েছে। এমনকি চলমান এই নিধনযজ্ঞ বন্ধ না করায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরোজা বন্ধ করে তাদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো কঠোর পথেও হেঁটেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আগস্টের শেষ দিকে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর চালানো সহিংসতা-নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন: নৃশংসতার জন্য কেউ দায়ী হলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা অপরিহার্য। চলমান সহিংসতা বন্ধে বার্মিজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করা ও দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য সকল রকম সেনা সরঞ্জামাদি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চলমান নিষেধাজ্ঞাসহ জবাবদিহিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেও তখন জানান।

বর্মী জেনারেলদের সঙ্গে অং সান সু চি

বর্মী জেনারেলদের গৃহীত এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে: ‘লেহি আইন’ অনুসারে, বার্মার উত্তরে রাখাইন রাজ্যের সামরিক কর্মকাণ্ডে যেসব কর্মকর্তা ও ইউনিট জড়িত তাদের সকলকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপ্রাপ্ত যেকোন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের কাছে পাঠানো আমন্ত্রণপত্র বাতিল করেছে পররাষ্ট্র দপ্তর।

এছাড়া বর্তমান ও সাবেক বার্মিজ সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য ‘জেড’ অ্যাক্ট ভ্রমণে যে সুযোগ দেয়া ছিলো গত ২৫ আগস্ট থেকে তাতে কিছু পরিবর্তন এনেছে পররাষ্ট্র দপ্তর। ‘জেড’ অ্যাক্টের অধীনে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অবরোধের উপায়গুলো নিয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও তখন তিনি জানিয়েছিলেন।

মিয়ানমার সরকার যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘ সময় ধরে রাখাইনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঢুকতে দিচ্ছে না, তাই সেখানে জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমকে প্রয়োজনীয় এলাকায় অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়ার আহ্বান জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদেশ ও সহযোগীদের সাথে জাতিসংঘ, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও অন্যান্য যথাযথ অবস্থানে বার্মার জবাবদিহিতার  বিষয়ে আলোচনা করা হবে বলেও জানানো হয়। এতকিছুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যারা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে অথবা বাস্তুহারা হয়েছে তাদের নিরাপদ ও স্বেছায় ফিরে যেতে সহযোগিতা করা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত বৈষম্যের মূল কারণ খুঁজে বের করে তা বন্ধ করা।

এমনকি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ জন আইনপ্রণেতার পাঠানো চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনে আয়োজিত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন: পুরো বিশ্ব তো আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু অলসভাবে ওই অঞ্চলে (রাখাইন) চলমান নৃশংসতা দেখতে পারে না। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম নির্যাতনের জন্য দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে যুক্তরাষ্ট্র দোষী মনে করে পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ‘ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন’বলেও জানান টিলারসন।

রোহিঙ্গা-মিয়ানমার-রেক্স টিলারসন
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন

যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে ‘অর্থবহ পদক্ষেপ’নিতে ওয়াশিংটনকে ৪৩ জন আইনপ্রণেতার পাঠানো চিঠিতে স্বয়ং টিলারসন বলেছেন: মার্কিন সরকার বুঝতে পারছে যে, মিয়ানমারে জঙ্গিবাদ সমস্যা রয়েছে। কিন্তু এর মোকাবিলা করার জন্য সেনাবাহিনীকে অবশ্যই সুশৃঙ্খল ও সংযতভাবে কাজ করতে হবে এবং ওই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে যেন বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের জবাবদিহিতা সবার কাছে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়। যদি খবরগুলো সত্যি হয়, কাউকে না কাউকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং এটা বার্মার সামরিক নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে, তারা বার্মার ভবিষ্যৎ কোনদিকে নিয়ে যেতে চান।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে: মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমারের উপর চাপ বাড়াবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে বলেও সবসময় অঙ্গীকার করে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের কারণে স্বাভাবিকভাবে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো এই ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে আসছিলো। যুগের পর যুগ সেনা শাসনের অধীনে থাকা এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একঘরে থাকা অগণতান্ত্রিক মিয়ানমার এসব বিষয়কে যদিও তেমন একটা পাত্তা দেয়নি, তবুও এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এর একটা বাহ্যিক ফলাফলও আমরা দেখেছি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে অব্যাহত চাপ আসায় এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের আগেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে চালানো অভ্যন্তরীণ তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। যদিও প্রকাশিত এই ফলাফলে মিয়ানমার নিজের চিরাচরিত মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, কথিত ফলাফলে যদিও তারা বলেছে সেনাবাহিনী কোন অন্যায় করেনি, তবুও আশার বিষয় ছিলো- রাখাইনের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মং মং সোয়েকে প্রত্যাহার করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে বুঝা যায়, টিলারসনের সফর নিয়ে বেশ চাপে ছিলো মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইনে সহিংসতার মূল নাটের গুরু সেখানকার সেনাবাহিনী।

সু চির সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক। আসেম সম্মেলনের আগে মিয়ানমার ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান ‘পরিবর্তন’ করে চীন।

কিন্তু এবারও আশায় গুড়েবালি। এতদিন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বড় বড় হুঙ্কার ছেড়ে সু চির সামনে দেখা গেল অন্য এক টিলারসনকে। এ যেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে অন্য এক যুক্তরাষ্ট্র। সু চির সঙ্গে সাক্ষাতের পর যৌথ কনফারেন্সে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সুর বদল করে এবার বললেন: রোহিঙ্গা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনই নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের আহ্বান জানান তিনি। এতে মিয়ানমারের মধ্যে থাকা ভীতি আর না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা জেনে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র এতদিন তাদের বিরুদ্ধে যে হুঙ্কার দিয়ে এসেছিলো তা আসলে শিকার ধরার জন্য হুঙ্কার নয়, বরং শিকারকে ভয় দেখিয়ে নিজের দলে আনার কৌশল ছিলো।

তাহলে আসলেই কি যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে মিয়ানমারকে মূলত চীন, ভারত এবং রাশিয়ার বলয় থেকে মুক্ত করে নিজেদের মেরুতে নিয়ে আসার জন্য এসব লোক দেখানো হুঙ্কার দিয়ে আসছিলো? মিয়ানমার সফরে গিয়ে অং সান সু চির সঙ্গে রেক্স টিলারসন যৌথ কনফারেন্সে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার আলোকে এ ধারণা বা মন্তব্য করলে কি তা আসলেই অমূলক হবে? এর একটাই উত্তর; আর তা হলো- না। এ ধারণা মোটেও অমূলক হবে না।

আসলে চীন, রাশিয়া যেমন নিজের স্বার্থে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে নিজের পাশে চায়, তেমনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরম বন্ধু হয়ে কোটি কোটি বাঙালি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে মিয়ানমার সফরে গিয়ে অং সান সু চি এবং সেখানকার সেনা কর্মকর্তাদের গিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন! সুতরাং স্বার্থই যেহেতু এখানে মানবতার চেয়েও বড় বিষয়, তখন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে কেন? তারা কেন চাইবে না মিয়ানমারকে চীন, রাশিয়া এবং ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করে নিজেদের দিকে টানতে?

রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার জন্য হলেও এই সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানবতা ধুলায় গড়াগড়ি খেলেও কার কী আসে যায়? জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে ৬০ শতাংশ শিশু, নিজেদের স্বজন আর সম্ভ্রম হারিয়ে লাখ লাখ নারীর কান্নায় কারও কিছু আসার তো দরকার নেই! সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক আর ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে যাদের হাতে মরছে লাখ লাখ মানুষ, তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডে কী আসে যায়।

চীন, ভারত, রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা বলার এই মুহূর্তে আত্মসমালোচনা হিসেবে আমাদের কথা যদি বলি, তাহলে আমরা আমাদের মানবতাও তো সিলেক্টিভ বা ক্ষেত্রবিশেষে একেক ধরণের দেখতে পাই। এই যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা ভুক্তভোগী কিংবা রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় মুসলমান বলে তাদের জন্য আমাদের যেই মানবিকতা, কিন্তু অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জন্য তা একেবারেই বিপরীত। ন্যায়সঙ্গতভাবে তারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আমাদের আপন মনে হলেও এদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী আমাদের কাছে নিরাপদ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে রংপুরের গঙ্গাচড়া কিংবা  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর অথবা রামুর দিকে তাকালে তা খুবই সুস্পষ্ট। এমনকি অনেকেই তাদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করার পক্ষেও মত দেন! কেউ প্রকাশ্যে, কেউ হয়তোবা গোপনে। তবে এরপরেও মানুষ বাঁচে আশায়, আর মানবতা বাঁচে ভালোবাসায়। শেষ পর্যন্ত শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে মানবতা আর ভালোবাসা হোক আমাদের প্রধান অবলম্বন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)