মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত এক বাঙালি সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদন চুড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
মঙ্গলবার ধানমন্ডির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই তদন্ত প্রতিবেদন চুড়ান্ত করার কথা জানিয়েছেন তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান। এসময় জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক ও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেডএম আলতাবুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান জানান: ‘অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (অব:) মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
পরবর্তীতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে কুমিল্লার সেনানিবাসে যোগ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নিজ এলাকা দাউদকান্দি সদরে ক্যাম্প স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই এলাকায় আটক, নির্যাতন, অপহরণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।’
সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা যায়: ২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর এ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে এ তদন্ত চলেছে। আজই তদন্ত প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কাছে দাখিল করা হবে।
গত বছরের ২৪ জুলাইয়ের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২ আগস্ট এ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ওই দিন কুমিল্লা জেলা পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করে।
পরদিন অর্থাৎ ৩ আগষ্ট আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করলে ট্রাইব্যুনাল তাকে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। আসামী বর্তমানে করাগারে আছেন। তার বিরুদ্ধে সাক্ষী করা হয়েছে ১৯ জনকে। এছাড়াও জব্দ তালিকার সাক্ষী করা হয়েছে আরও তিন জনকে। মোট সাক্ষী ২১ জন।
মুহাম্মদ শহীদুল্লার জন্মস্থান কুমিল্লার দাউদকান্দিতে।
আসামীর বিরুদ্ধে ৩ অভিযোগ:
অভিযোগ-১:
৭ জুন ১৯৭১ তারিখ বিকেল অনুমান ০৪.০০ টা হতে রাত্রি অনুমান ০৮.০০ টা পর্যন্ত সময়ে আসামী মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্ পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ৮/১০ জন সদস্য সহ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানাধীন দাউদকান্দি বাজারে হোমিও ওষধের দোকানে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ডাঃ হাবিবুর রহমানকে আটক করে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নির্যাতন পূর্বক দাউদকান্দি ফেরীঘাট সংলগ্ন গোমতি নদীতে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
অভিযোগ-২:
১৬ জুন ১৯৭১ তারিখ ফজরের নামাজের পর হতে সন্ধ্যা অনুমান ০৭.৩০ পর্যন্ত সময়ে আসামী মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্ পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ৪০/৫০ জন সদস্যসহ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানাধীন উত্তর ইউনিয়নের চেঙ্গাকান্দি, গোলাপেরচর গ্রামে হামলা চালায়। এসময় স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ নিরস্ত্র ২০ জনকে অন্যায় আটক করে নির্যাতন, ৫টি বাড়ীর মালামাল লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়।
আটককৃত ২০ জনের মধ্যে ৫ জনকে ছেড়ে দিয়ে ১৫ জন নিয়ে মান্নান ফরাজীর বাড়ীর সামনে এনে মান্নান ফরাজীর একটি বড় গরু জবাই করে জবাইকৃত গরুর ২ রান নিয়ে আটককৃত ১ জনকে ছেড়ে দেয়।
এরপর আটককৃত ১৪ জনকে দাউদকান্দি সেনা ক্যাম্পে নেয়ার পথে গোলাপেরচর টেকে এনে লাইন করে দাঁড় করায়। লাইন থেকে এক জনকে বের করে ৫০/৬০ হাত দুরে গোমতী নদীর কিনারে নিয়ে আসামী মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্ তাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীর কিনারে ফেলে দেয়।
আটককৃত ১৩ জনকে নিয়ে নৌকাযোগে দাউদকান্দি পাকিস্তান দখলদার সেনবাহিনী ক্যাম্পে এনে নির্যাতন পূর্বক মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর দিতে এবং হত্যার ঘটনা কাউকে না-জানানোর শর্তে আটককৃতদের সন্ধ্যার পূর্বে ছেড়ে দেয়।
অভিযোগ-৩:
২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখ দুপুর অনুমান ০৩.০০ টা থেকে রাত ১০.০০ টা পর্যন্ত সময়ে আসামী মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্ পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি বাজারে হামলা চালিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নিরীহ নিরস্ত্র ড্রাইভার কালামিয়া-কে আটক করে নির্যাতন পূর্বক পাকসেনাদের গাড়ীতে তুলে চান্দিনা থানাধীন চান্দিনা হাসাপাতালের পিছনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দেয়।