চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাকে কাঁধে করে নিয়ে আসা কাশেমের সঙ্গে অমানবিক সেলফি

৩ সেপ্টেম্বর আমরা রওনা হই টেকনাফের উদ্দেশ্যে। অফিস সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে এর একদিন আগে, ২ সেপ্টেম্বর যেদিন ছিলো কুরবানীর ঈদ। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য কক্সবাজারের যাওয়ার গুরুদায়িত্বটা দিয়ে কীভাবে কাজ করতে হবে তার কিছুটা ধারণা দিয়েছেন অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর আরেফিন ফয়সল। তবে বাস্তবতা আর ধারণা দুটো দুই বিষয়। হয়ত যারা সাংবাদিকতা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত তারা বিষয়টি অনেকের থেকে বেশি জানেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তখন দুয়েকটি সংবাদভিত্তিক চ্যানেল বাদে সবাই মোটামুটি কক্সবাজারের স্থানীয় প্রতিবেদকের মাধ্যমেই খবর প্রচার করছিল।

কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা করার আগেই একটি শব্দটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল: শরণার্থী। একদিন আমরাও এরকম শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছিলাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও সময় ১৯৭১ সালে। আমার জন্মেরও প্রায় ১৭ বছর আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকেও প্রায় ১ কোটি বাঙালি শরণাার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল পাশের দেশ ভারতে। তখন ভারত বাংলাদেশের এ অসহায় মানুষগুলোর পাশে ছিল।

এর সবই আমি বইয়ের পাতায় পড়েছি, কিছু শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে, আবার কিছু শুনেছি সভা-সেমিনারে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকেও ধারণা হয়েছে আমার। তবে কল্পনার চোখে দেখা এর সবকিছুই আমার বাস্তব ধারণার বাইরে ছিল। তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করার এই সুযোগ আমার মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি করে তখন।

ক্যামেরাম্যান আবুল কাশেম এবং লাইভ সম্প্রচারের জন্য বিপ্লব রায়কে সঙ্গে নিয়ে আমরা রাত ৮টার দিকে যাত্রা শুরু করি। যাত্রাপথে গাড়ির চালক মুন্নার রোহিঙ্গা নিয়ে অনেক কৌতুহলের জবাব দিলেও নিজেই এ ইস্যুতে বাস্তব তেমন ধারণা না থাকায় পুরোপুরি উত্তর না দিয়েই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়েছি। কারণ তখনও রোহিঙ্গারা আমার কাছে টিভি আর ফেসবুকে দেখা কিছু অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের মুখ মাত্র।

বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত ২৮৩ কিলোমিটারের। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জাতীয় নিবন্ধন সনদের পরিবর্তে বিদেশি নিবন্ধন কার্ড দেওয়া হয় এবং তাদেরকে আদমশুমারির বাইরে রাখা হয়। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আশির দশকে মিয়ানমারে নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯১-৯২ সালে নির্যাতন, নিপীড়নের কারণে আরো প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পরিসংখ্যানটা তখনও মাথায় ঘুরছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে এবার আর কত রোহিঙ্গাকে মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় দিতে যাচ্ছে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অষ্টম অবস্থানের বাংলাদেশ, প্রশ্নটি তখনও মনের ভেতরে। শুরুর দিকটায় কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়া দিয়েই বেশি রোহিঙ্গারা ঢুকছে। কিছু ঢুকছে বান্দরবান দিয়েও। সীমান্তবর্তী জায়গাগুলোতে পৌঁছানোর জন্য থাকার হোটেল ভাড়া করলাম টেকনাফেই।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংবাদ করাটাই তখন প্রধান গুরুত্ব, তাই বিশ্রাম খুব একটা নেওয়া হলো না। ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টায় টেকনাফ পৌঁছে সকাল ১০টার দিকেই বের হলাম রোহিঙ্গাদের খবর সংগ্রহে। টেকনাফ উপশহর থেকে শাহপরীর দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। এখান দিয়েই তখন রোহিঙ্গাদের ঢল আসছে বাংলাদেশে। শাহপরীর দ্বীপে আমরা যখন প্রথম পৌঁছাই তখন প্রায় দুপুর হতে চলেছে, ঘড়ির কাঁটা ১১টা ৩০ পার হয়েছে মাত্র। বইয়ের পাতার নাফ নদী প্রথমবারের মতো বাস্তবে চোখের সামনে ধরা দিলো। এই নাফ নদী আলাদা করেছে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারকে। নাফ নদীর স্বচ্ছ পানি দেখে মন ভরে যায়। তবে মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে গেল যখন মনে পড়লো নাফের জলেই প্রতিদিনই অসহায় রোহিঙ্গাদের লাশ মিলছে।

শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির কিছু সদস্যকে টহল দিতে দেখলাম। নাফ নদীর এপাশ ওপাশ বারবার তাকিয়েও কোন রোহিঙ্গা বা রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা চোখে পড়লো না। আগের ধারণার সঙ্গে বাস্তবের চিত্রের মিল খুঁজে না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলাম। ভাবলাম রোহিঙ্গাদের যে ঢলের কথা, রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর নির্যাতনের যে কথা বলা হচ্ছে তা কি আসলেই বাস্তব নাকি নিছক প্রচারণা? স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে রোহিঙ্গা খুঁজতে ছুটে গেলাম বিজিবির একটি ক্যাম্পে। সেখান থেকে বলা হলো কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করা হলেও তাদের আবার মিয়ানমারেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে বিজিবি। তবে শাহপরীর দ্বীপেরই একটি জায়গায় বেশ কিছু রোহিঙ্গা আটক রয়েছে বলে জানালেন বিজিবির এক কর্মকর্তা। তারা সেখানে তখনও আটক আছেন কিনা মোবাইলেও নিশ্চিত হলেন তিনি। দুপুর সোয়া ১টা বেজে গেছে তখন। দুপুর ২টার সংবাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। তড়িঘড়ি করেই একটি সিএনজি নিয়ে আমরা রওনা দিলাম রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে। সংবাদকর্মী হিসেবে এবার আর হতাশ হলাম না।

সেখানে একসঙ্গে দুশোর বেশি রোহিঙ্গাকে আটক করে রেখেছে বিজিবি। ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে তাদের আটক করা হয়। কথা হলো কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে। জানা হলো কিছুটা বাস্তবতা। এই রোহিঙ্গাদের একজনের নাম মোহাম্মদ রহিম। শুধু জীবনটা নিয়েই পালিয়ে এসেছেন তিনি। তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারিরা। স্ত্রী-সন্তান কারও খোঁজ জানা নেই। রহিম জানালেন, তার বড় ভাবির সঙ্গে নৌকায় উঠেছিলো স্ত্রী-সন্তানরা। তখনও সে নৌকা পৌঁছায়নি নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে। গতরাতেই নাফ নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ অনেকে। তাই আতঙ্ক কাজ করছিলো রহিমের চোখে মুখে।

আটক হওয়াদের আরেকজন আনোয়ার হোসেন। রাখাইনের মংডুর বাসিন্দা তিনি। আনোয়ারের চোখের সামনেই তার মা-বোনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। দুঃসহ সেই স্মৃতি তখনও তার চোখে মুখে। আনোয়ার জানালেন, ১২ কানি (৩৬ বিঘা) জমি আছে তাদের। দু সপ্তাহ বাদে ফসল কাটার কথা ছিলো। তবে সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছে মগেরা (স্থানীয় বৌদ্ধদের মগ বলে রোহিঙ্গারা)। হত্যার আগে তার ছোট বোন রেহেনাকে গণধর্ষণও করা হয়। একথা বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আনোয়ার। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলি লাগলেও প্রাণে বেঁচে যান আনোয়ার। মৃতের অভিনয় করে চুপ করে লাশের মতো পড়েছিলেন তিনি। মিলিটারি চলে গেলে টানা ৭ দিন পাহাড়ী রাস্তা আর জঙ্গল পার হয়ে বাংলাদেশ পৌঁছান। বিজিবির পক্ষ থেকে তখনো তাদের কোন খাবার সরবরাহ না করা হলেও কক্সবাজারের স্থানীয়রা ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন।

সেদিন দুপুর ২টার চ্যানেল আইয়ের সংবাদের লাইভ সম্প্রচারে এদের কথাই তুলে ধরি আমরা। অসহায় রোহিঙ্গাদের কিছু খবর তুলে ধরতে পেরে নিজেরাও কিছু একটা করতে পেরেছি এ চিন্তা নিয়ে ফিরতে শুরু করলাম হোটেলের দিকে। নাফের জলে তখনও নেই কোন রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা। আগেই জন্ম নেওয়া প্রশ্ন আবারও মনে পড়লো: রোহিঙ্গারা তাহলে ঢুকছে কখন? প্রশ্নের উত্তর না পেয়েই ফিরলাম হোটেলে। সন্ধ্যার পর আবার বের হলাম। রাস্তায় তখনও রোহিঙ্গাদের আনাগোনা কম।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। কাদামাখাা ফোসকা পড়া পা নিয়ে শত মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথা মনে পড়লো। এদের প্রায় সবারই হাতে একেকটি চটের বস্তা, যাতে প্রয়োজনীয় নানা জিনিস দড়ি দিয়ে বস্তাবন্দি করা। অনেকে আবার হাতে নিয়ে মুরগী নিয়ে আসছেন। চিন্তা করতে থাকলাম জীবন নিয়ে যেখানে পালানো দায় সেখানে পরিবারগুলোর কাছে গৃহপালিত মুরগীটিও কতটা আপন। পরিবারের যারা বড় তাদের হাতে দেখা যাচ্ছিলো জমির দলিল, মিয়ানমারের কার্ড। তখনও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের অনুমতি মেলেনি। বিজিবিও তাই জনসমুখে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

রাত সাড়ে ১২টার দিকে আমরা গেলাম সীমান্তবর্তী জাইলাপাড়ায়। দুর্গম এ পথের একেবারে শেষ সীমায় নাফ নদীর পারে গিয়ে দেখা গেলো রোহিঙ্গাদের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি দল বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করে শহরের দিকে রওনা হয়েছে। ওই রাস্তা দিয়েই হেঁটে গেলাম একেবারে নাফ নদীর পারে। সেখানে স্থানীয় কিছু বাঙ্গালীর দেখা মিললো। স্থানীয়দের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, এরাই রোহিঙ্গাদের নাফ নদী পার করে বাংলাদেশে ঢোকাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে যারা গরু চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত তারাই এখন স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পৌঁছে দিচ্ছে। যে পথ দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে সে পথের শেষে দেখা মিললো একজন বিজিবির কর্মকর্তা এবং একজন সদস্যের। তখনই নাফ নদীর ওই পথ দিয়েই তীরে ভিড়লো রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা। সাংবাদিক দেখে বিজিবির ওই দুই সদস্য নৌকাটি তীরে ভিড়তে দেয়নি। নৌকার মাঝি বারবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেও তাতে কান দিতে দেখা গেলো না বিজিবির সদস্যদের। তড়িঘড়ি নৌকা পুশব্যাক করতে ব্যস্ত সদস্যের শারীরিক ভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো ভুল সময়ে চলে এসেছি আমরা। আমাদের কারণে যদি তাদের ফিরে যেতে হয় তাহলেও দায়টা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের উপরও আসে ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলাম।

দ্রুত তাই জাইলাপাড়া থেকে ফিরে আবার সামনের দিকে এগোই। এর ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে যাবার সময় আবারও জাইলাপাড়ায় ঢুঁ মারলাম। তখন আগে ফিরিয়ে দেওয়া নৌকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ঢুকে পড়েছে। তাদের কাছে জানতে পারলাম, নাফ নদী পার হতে তাদের জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দালালদের দিতে হয়েছে। অনেককে আবার টাকা না দেওয়ায় আটকে রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে টাকার পরিবর্তে সঙ্গে থাকা স্বর্ণও দিয়েছেন। মাত্র ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় প্রতিভরি স্বর্ণ কিনছে দালালরা। স্থানীয় দালালদের বেশিরভাগই অভিযোগ অস্বীকার করলেও কেউ কেউ স্বীকার করলো টাকা আদায়ের বিষয়টি। তারা জানালো, একেকজন রোহিঙ্গাকে পার করতে বিজিবি সদস্যদের ২ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। বিজিবি এবং কোস্টগার্ডের কিছু সদস্যের টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন পর বিডিনিউজসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম খবরও প্রকাশ করে।

সেখানে দেখা মিললো কাশেম আলী নামের এক রোহিঙ্গার। তখনই নৌকা পার করে মাকে নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছেন তিনি। তার বাড়ি ঘর সব-পুড়িয়ে দিয়েছে নিজ দেশের সেনাবাহিনী। ভিটেমাটি হারিয়ে মাকে কাঁধে করে একটানা ৫ দিন হেঁটে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। আসার সময় সামান্য যে অর্থ সঙ্গে ছিল তাও দালালদের দিয়ে নিঃস্ব কাশেম জাইলাপাড়ায় মাকে নিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর ঢাকা থেকে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে আসা একজন মধ্য বয়সী লোক কাশেমের হাতে একটা ১শ টাকার নতুন নোট তুলে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সেলফি তুলতে।

রাস্তার পাশে শতবর্ষী মাকে নিয়ে বসে থাকা কাশেমকে রেখে আমরা ফিরছিলাম হোটেলে দিকে। তখন টেকনাফের রাস্তায় একটু পর পরই রোহিঙ্গাদের দল হাঁটছে। বুঝে নিলাম দিনে নয়, রাতেই ঢুকছে রোহিঙ্গারা। (চলবে)