চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মসুলে আইএসের মর্গ: নৃশংসতার আরেক সাক্ষী

কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। বিশেষ ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড ছিল আরো ভায়াবহ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সহযোগিতায় দেশ দুটিতে শক্ত অবস্থান হারিয়েছে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। কিন্তু তাদের নৃশংসতা এখনও দগদগে।

ইয়াহু নিউজ জানায়, আইএসের এই নৃশংসতার সাক্ষী ইরাকের মসুলের একটি মর্গ। বিভিন্ন অপরাধের দায়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে তারা ডেথ সার্টিফিকেট (মৃত্যু সনদ) দেয়। তাদের এই মর্গের কর্মকাণ্ডের নথি গোপনে সংরক্ষণ করেন রাখেন সেখানে নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সেখানে কাজ করেন। ট্রাকের পর ট্রাক লাশ এনে ফেলে দেয়া হয় তাদের সামনে। ছিন্নভিন্ন এসব লাশ। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো মাথা নেই। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে গণকবর দেয়া হয় এসব লাশ।

কমান্ডারের নির্দেশ পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার কোন বিধান নেই আইএসের কাছে। মর্গের স্টাফরাও কখনো কোন লাশ পরিবারের কাছে ফেরত দেননি। তারা জানেন এই কাজের জন্য নিজেদের জীবনও যেতে পারে।

তবে একটি লাশের ক্ষেত্রে ঘটে ব্যতিক্রমী ঘটনা। একদিন এক তরুণের লাশ আসে মর্গে। ধর্ম অবমাননার দায়ে এই তরুণের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আইএস। স্বাস্থ্য সহকারী সামেহ আল আজ্জাউই এই তরুণের ময়নাতদন্ত করেন। মাথাবিহীন এই লাশ দেখে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

তবে আল আজ্জাউই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের কাছে নববিবাহিত এই তরুণের লাশ হস্তান্তর করেন। মাত্র চার মিনিটের মধ্যে তিনি মাথা দেহের সঙ্গে লাগিয়ে পরিবারের হাতে তুলে ধরেন।

নিয়মতিই তাদেরকে এ ধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হতো। আল আজ্জাউইকে একদিন নিজের চাচাতো ভাইয়ের লাশের ময়নাতদন্ত করতে হয়েছিল। এই ঘটনা তাকে আরো পীড়া দেয়।

এরপর আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে সিরিয়া সীমান্তের কাছে গিয়ে ধরা পড়েন। এরপর তিনি ১০ দিন বন্দী ছিলেন। পরে এ ধরনের কাজ না করার শর্তে মুক্তি পান। এরপর থেকে আইএস যা বলে তিনি তাই করেন।

আবার আরেকজন স্টাফ একদিন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। লাশের গাদা যখন তার সামনে ফেলা হয় তখন তিনি খেয়াল করেন একটি দেহ জীবিত আছে। উত্তেজনায় তিনি চিৎকার করে ওঠেন। কিন্তু পরক্ষণই বুঝতে পারেন তিনি ভুল করে ফেললেন। তার চিৎকারে আইএস জঙ্গীরা এসে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ওই জীবিত ব্যক্তিকে মেরে ফেলে।

এরপরও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে যান। পাশাপাশি বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে লাশের হিসাব রাখার চেষ্টা করেন। তাদের একটি এক্সেল সিট থেকে জানা যায়, ১২শর বেশি লোককে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে তারা এসব লোককে হত্যা করেছে।

এতে দেখা যায়, সপ্তাহে গড়ে তারা ১১ জনকে হত্যা করেছে। এই তালিকায় ১২ জন নারীকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ৯৫ জনকে দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে এবং ৫০ জনকে উপর থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে।

আইএস জঙ্গিরা ধর্ম অবমাননা, গুপ্তরচরবৃত্তির অভিযোগসহ নানা অজুহাতে এসব লোকদের হত্যা করে। পরিবারের কাছে ফেরত না দিয়ে কবর দিয়ে দেয়। একবার এক হাজার লাশের কোন ময়নাতদন্ত ছাড়াই গণকবর দিয়ে দেয়। মর্গের স্টাফরাও এসব লাশের তথ্য রাখাসহ পরিচয় জানতে পারেননি।

সম্প্রতি ইরাকি সৈন্যরা মসুল দখলে নিয়েছে। আইএস পরিচালিত সেসব মর্গও দখলে নিয়েছে সৈন্যরা। আইএস জঙ্গিরা পালিয়ে গেছে। অনেকে নিহত হয়েছে। তবে মর্গের সেইসব স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে স্টাফদের। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঠিকমতো ঘুমাতো পারেন না। এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় দুঃসহ সেসব স্মৃতি।