কেন জানি বেশ কিছুদিন ধরেই বাদশাহ নমরুদের কথাটা বারবার ঘুরেফিরে মাথায় আসছে। নমরুদ শুধু যে প্রবল প্রতাপশালী এবং দুর্বিনীত শাসকই ছিল, তা নয়, নমরুদ নিজেকে সৃষ্টিকর্তা বলেও দাবি করতো। নমরুদ বহুবার, বহুভাবে হযরত ইব্রাহিম (আ:) কে হয়রানি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই চরম বদমাইশের বাহিনীকে কাবু করার জন্য পাঠানো হয়েছিল একদল মশাকে। আমরা মশাকে যতই ছোট, ফালতু ও গুরুত্বহীন প্রাণী মনে করি না কেন, মশা কিন্তু পরাস্ত করেছিল ঐ নমরুদকে। আর স্বয়ং নমরুদকে কাইৎ করার জন্য স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছিল একটি আরো ছোট মশা, যে নাকি নমরুদের মগজের মধ্যে ঢুকে তারে পাগল বানিয়ে ছেড়েছিল।
হঠাৎ এতকিছু থাকতে আমার নমরুদের মশার কাহিনী মনে হওয়ার কারণ আর কিছু নয়, কারণ হচ্ছে এখন ঠিক সেরকম ক্ষমতাশালী একদল মশার উপস্থিতি টের পাচ্ছি। চিকুনগুণিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়ার মতো এই ভয়াবহ রোগগুলো শুঁড়ে শুঁড়ে বহন করে নিয়ে বেড়াচ্ছে এইসব মশা। এরা অপ্রতিরোধ্য। হয়তোবা ঢাকাবাসীকে নিধন করার বা নাকাল করার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তারা এসেছে। কারণ আমরা যারা ঢাকায় থাকি, তারা নিজেরাই এই শহরটাকে যেমন-তেমনভাবে নোংরা করছি। ঠিক একইভাবে শহরটাকে পরিস্কার করার দায়িত্ব যাদের, নগরবাসীকে সচেতন করার কাজ যাদের, তারাও তাদের দায়িত্ব পালন করছেনা। ফলে মশার আর কী দোষ। আমাদের গাফিলতির কারণে মশা জন্ম নেয়ার মত নোংরা-আবর্জনাময় জায়গার অভাব নেই ঢাকাতে। অন্যদিকে মশা নিধনেরও কোন উদ্যোগ নেই। ফলে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে মশকবাহিনী। একটি থেকে দুটি সিটি কর্পোরেশন হয়ে গেছে। চাইকি কাজের সুবিধার্থে ভবিষ্যতে চারটিও হতে পারে কিন্তু নগরবাসীর নাজেহাল হওয়ার ঘটনা বাড়ছেই।
চিকুনগুনিয়া ও প্রাণঘাতি ডেঙ্গু রোগটি একবার যার হয়েছে, সে জানে একটি ছোট্ট মশার কি অসীম ক্ষমতা। অনেকে চিকুনগুনিয়ার নাম দিয়েছে হাড় গুরগুরিয়া রোগ। একবার এই রোগ হলে মাসখানেক অব্দি রোগীকে ব্যথায় কাবু করে রাখছে। আর মাথা ব্যথা এত বেশি থাকে যে রোগীর অবস্থা পাগল হওয়ার মতো। মশাটি এতই ছোট বা চিকন যে তাকে সাদা চোখে নাকি কমই দেখা যায়। হয়তোবা কোন একদিন ফোর-ডি চশমাই আবিস্কৃত হয়ে যাবে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মশাকে দেখার জন্য।
মহানগরী ঢাকার উপরি জৌলুস যতই বাড়ুক না কেন, নগরীটা যে নোংরাই থেকে যাবে অন্তত এ বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। কারণ এই নগরীর পরিধি বাড়ছেনা, বাড়ছেনা নাগরিক সুবিধাদি। উপরন্তু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিন/চারগুণ বেশি মানুষ বাস করছে এবং এই হার বাড়ছেই। বসবাসকারীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নোংরাভাবে বসবাস করছি। অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী বলে বস্তি এলাকায় যেমন-তেমন করে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, আবার অনেকেই বড় বড় ভবনে বাস করলেও চারপাশটা নোংরা করে রাখে। বহু মানুষকে দেখেছি দামি প্রিমিও গাড়িতে চেপে যেতে যেতে হঠাৎ কাঁচটা নামিয়ে কোকের ক্যান রাস্তার পাশে ছুঁড়ে মারছে, প্রাডো গাড়িতে যেতে যেতে স্যুট-টাই পরা লোক কাঁচ নামিয়ে একদলা থুথু ফেললো। এটা খুব কমন একটি চিত্র।
আমি যে ভবনে থাকি, তা ঢাকা শহরের একটি ভালো ও পরিচ্ছন্ন এলাকা বলে পরিচিত হলেও, আমি জানি আমাদের ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর থেকে কত পরিমাণে ময়লা ভবনের চারপাশে ফেলা হয়। দেখলে মনে হবে কোন ময়লার ভাগাড়। শিক্ষিত ও ভদ্র বলে দাবিদার আমাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকি অনেক জায়গায় বসবাসরত মানুষের চারপাশের পরিবেশটা সহজেই অনুমেয়।
শুধু যদি সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, পান্থপথ, ধানমন্ডি লেক, সংসদ ভবন, মীরপুর রোড, রায়েরবাজার, বেড়িবাঁধ বা মোহাম্মদপুরের কথাই বলি- দেখবেন রাস্তার পাশে স্ট্রিট ফুডের অজস্র দোকানসহ অনেক খাবারের দোকান, হোটেল বা রেষ্টুরেন্ট আছে। এরা সব ময়লা দোকানের সামনে, পাশে, পেছনে বা রাস্তার উপরে জমা করে রাখে। কেউ তাদের দোকানের সারাদিনে জমা হওয়া ময়লাগুলো সরিয়ে রাখেনা বা কোন একটা পাত্রে জমা করে রাখেনা। রাস্তায় বা দোকানের সামনে বা পথের পাশে ড্রেনে ফেলে রাখে। পথে যেতে যেতে দেখবেন, চারিদিকে নোংরার স্তুপ। আমরা নোংরা করি, ভাবি আর কেউ এসে তা সরিয়ে নেবে। কিন্তু এত ময়লা কে বা কারা সরাবে? যারা সরাবে, তারাইবা কতটা সচেতন? আমার ধারণা বাকি এলাকাতেও এরকম বা এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান। জানতে ইচ্ছে করে, যারা এভাবে হাতে ধরে শহরটাকে নোংরা করছে, তাদের সচেতন করানোর বা শাস্তি দেয়ার জন্য কি কোন কর্তৃপক্ষ নেই ?
আর তাই ঢাকার নাগরিক জীবনে এন্তার দুর্ভোগ। আমরা যারা ঢাকায় থাকি, তারা নিজেরাই নিজেদের চারপাশটা নোংরা করি। নূন্যতম কোন পৌরজ্ঞান কাজ করেনা আমাদের মধ্যে। ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র বা হতদরিদ্র যেই হইনা কেন, পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে আমরা উদাসীন। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ মনে করে ঢাকায় যদি থাকতে চাও ট্যাক্স দিয়ে এসবকে সাথী করে নিয়ে থাকতে হবে। মশা, মাছি, খানা-খন্দ, শব্দদূষণ, ভীড়-ভাট্টা, ট্র্যাফিক জ্যাম, ভেজাল খাবার, বস্তিজীবন, অনিরাপদ পরিবেশ, ছায়াহীনতা, নাগরিক কপটতা, উচ্চচাপ, নিম্নচাপ, আজ ডেঙ্গু, কাল চিকুনগুনিয়া। এই নিয়েই এতগুলো বছর এই নগরে বাস করছি। কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর আমাদের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্ব স্ব জায়গায় দায়িত্বে গাফিলতি করেও গোঁফে তা দিয়ে দিব্যি আছেন। সত্যি বলতে কি, পুরো নগরীটাই দিনকে দিন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে মশা, মাছি, চিকা, ইদুঁর আর এসব প্রাণীবাহিত রোগ।
সত্যি বলতে কী নগরীতে বসবাসকারী অধিকাংশ পরিবারে পরিস্থিতিটা এরকম দাঁড়িয়েছে যে- যেমন আপনি প্রবল জ্বর নিয়ে কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরলেন। বিছানায় থাকতে থাকতেই দেখবেন বাসার আরো ২/৩ টি উইকেটের পতন ঘটেছে। হয় চিকুনগুনিয়া, নয় ডেঙ্গু। আর বাকি ২/১ জনের ভাইরাল জ্বর, ফ্লু, হাঁচি-কাশি, ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা বা আরো অন্যকিছু। তাছাড়া ঢাকা শহরে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সবুজ বনবনানী, পাখির ডাক, নাগরিক সুবিধার অনেক অভাব থাকলেও রোগ শোক আর দুর্ভোগের কোন অভাব নেই।
গণমাধ্যম নাগরিক জীবনের অসহনীয় কষ্ট নিয়ে হৈচৈ করে বা করছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে গণমাধ্যমও তো এক বিষয় নিয়ে প্রতিদিন কথা বলতে পারেনা, কারণ তাদের সামনে আরো নতুন ইস্যু চলে আসে। অবশ্য ইতোমধ্যেই গণমাধ্যম নগরবাসীর নাকাল হওয়ার খবর দিতে দিতে হয়রান। নাগরিক নিজেরাওতো সোশ্যাল মিডিয়াতে তুলে ধরছেন। কিন্তু অবস্থা তথৈবচ।
নাগরিককে সচেতন করার, নগর পরিস্কার রাখার, মশার প্রজনন স্থানে ওষুধ ছিটানোর দায়িত্ব কার, এসব রোগ কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে- একথা জানানোর দায়িত্ব কার? এত যে গরম গেল, এই গরম মোকাবিলার কোন স্বাস্থ্য টিপস কি সংশ্লিষ্ট দফতরের কেউ জানিয়েছে আমাদের? না জানায়নি, জানায়ও না। মিডিয়া নিজ উদ্যোগে প্রচার করে অনেককিছু। স্যোশাল মিডিয়াতেও আসে সতর্কমূলক বার্তা। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব যাদের, তারাতো চুপচাপ।
সরকার তাদের বিভিন্ন অর্জন নিয়ে ক্রমাগত বিলবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়ালিকা, চিকা মেরে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রেতো দেখি লাফিয়ে লাফিয়ে যা দরকার তাও দিচ্ছে, যা দরকার নাই তাও দিচ্ছে। তাহলে জনস্বাস্থ্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও নগরপিতাদের এই উদাসীনতা কেন? কোথাও কোন প্রচার প্রচারণা কিচ্ছু চোখে পড়ছেনা তাদের পক্ষ থেকে।
সরকারি এসএমএস এর মাধ্যমে জেনেছি, পত্রিকাতেও দেখলাম চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে একটি দায়সারা গোছের সচেতনতা অভিযান চালানো হয়েছে। ডেঙ্গুর সময়ও এমনটা দেখেছি। কিন্তু মূল কাজটাইতা হচ্ছেনা। মশা জন্মানোর মতো নোংরা জায়গা আমরাই তৈরি করছি, মশা মারার জন্য কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনা, নগরের রাস্তাঘাট, পুকুর-জলাশয়ের বেহাল অবস্থা, কেউ কখনও এসব পরিস্কার করেনা- এইসব কিছু মিলেই মশা-মাছির বংশ বিস্তারের জন্য তৈরি হয়েছে বেশ অনুকূল পরিবেশ। সেখানে একদিনের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ কী ফল বয়ে আনবে, আমি জানিনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)