চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মরেও তুমি অমর শাজাহান সিরাজ

১৯৮৪ সালের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট সফল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের সাহসী ছাত্রনেতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। ধর্মঘটের সমর্থনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ দেশব্যাপী মিছিল মিটিংয়ের ডাক দেয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে উঠা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো আহুত ধর্মঘটকে সফল করার আহবান জানায়।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ধর্মঘট আহবান করলেও তা হরতালে রূপ নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কাজলার গেটে যখন সমবেত হচ্ছিল, তখন ছিল পুরো রাজশাহী শহর জুড়ে থমথমে অবস্থা। রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিডিআর-এর অবস্থান। অসীম সাহসী ছাত্ররা নেতৃবৃন্দের আহবানে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে এগুতে চাইলে বিডিআর মিছিলে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। শাহজাহান সিরাজ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান।

সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে শত শহীদের তালিকায় যুক্ত হয় আরেক মৃত্যুহীন নাম- শাহজাহান সিরাজ। আজ থেকে ৩২ বছর আগে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া অকুতোভয় শাহজাহান সিরাজকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়।

অত্যন্ত সাধারণ পরিবার থেকে আসা, সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় বিশ্বাসী একজন দৃঢ় সংগঠক সেদিন অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন সামরিক জান্তার বুলেটে। উল্লেখ্য ১৯৮২ সালে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ ওই বছরেই সামরিক শাসন প্রত্যাহার, শ্রমিক কর্মচারীদের ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ, অবাধ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দাবী করে স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপিতে সই করেন জাতীয় শ্রমিক জোটের শ্রমিক নেতা মরহুম মো. শাহজাহান, রুহুল আমীন ভূঁইয়া, সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা মুখলেসুর রহমান, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের আবুল বাসার এবং টি. ইউ. সি’র পক্ষে সাইফুদ্দিন মানিক ও জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতৃবৃন্দ।

এই দিনে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতিচারণ করে দু’একটি কথা বলতে চাই। আমি তখন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক। কমিটিটি অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্র থেকে ওই অকার্যকর কমিটি ভেঙে দিয়ে ১১ সদস্য বিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি করা হয়। আমাকে মনোনীত করা হয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আমি দায়িত্বগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করি। আমার যুক্তি ছিলো এই যে, মফস্বল শহর থেকে অতি সাধারণ পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলাম আমি। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা পরিস্থিতি তাতে ওই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বপালন আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। শাহজাহান সিরাজ সেই রাতে মুহসীন হলে ৩৬৪ নম্বর রুমে আমার সঙ্গে ছিলেন। এর আগে আমরা একসঙ্গে বেইলি রোডে ঢাকা থিয়েটারের ‘কীত্তনখোলা’ নাটক দেখি ও নাজিম উদ্দীন রোডে নীরব হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে গভীর রাতে হলে ফিরি। তিনি সারারাত ধরে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন আমি যাতে দায়িত্ব গ্রহণ করি। নিরুপায় হয়ে আমি শেষতক রাজি হই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিলেটের লোকমান আহমেদ সকালে হলে এসে আমার কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে নেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সামরিক জান্তার পেটোয়া বাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি, সেই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আমি তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। এরপর দায়িত্ব নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবী আদর্শে সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজ শুরু করি।

আজ বারবার মনে পড়ছে মিছিলের সেই সহকর্মীর কথা, যে আমরা চেয়েছিলাম সমাজ বদল করতে, সেই মিছিল থেকে কতজন ঝড়ে গেছে! আমি আজও বেঁচে আছি। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়েছে, ১৯৯০ সালে সেই বিজয়ী ছাত্র গণআন্দোলনে আমিও নেতৃত্বের কাতারে ছিলাম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)