অতিভারী নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণে এদের জন্ম হয়। এরা তুলনামূলক অনেক ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব ভারী। এরা মরা তারা। এদের মধ্যে ফিউশন বিক্রিয়া আর চলে না। এদেরই পোশাকি নাম নিউট্রন নক্ষত্র।
বছর চল্লিশেক আগে আইরিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোসলিন বেল বার্নেল নাক্ষত্রিক এই ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ হাজির করেছিলেন। এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে পারে, এটা তখন থেকেই জানতেন বিজ্ঞানীরা। ফলে অতিকাছাকাছি এলে এদের মধ্যে বাধে সংঘর্ষ। মরা তারাদের মহাধাক্কা থেকে কিছু কি জন্ম নেয়? কী?
এরকম দুটো মৃত নক্ষত্র পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। সেই মহাসংঘাতের দৃশ্য ১৩ কোটি বছর পর এ বছর ১৭ আগস্ট দেখা গেছে পৃথিবী থেকে। আলোকের একাধিক রূপ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উভয় বেশেই। মহাজাগাতিক মঞ্চে এমন ঘটনা এই প্রথম। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সংঘ লাইগো সোমবার এ ঘোষণা দিয়েছে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অনুমান করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন, ১৯১৬ সালে। এর একশ বছর পর ২০১৬ সালে সেই তরঙ্গ দেখার ঘোষণা দেয় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সংঘ লাইগো। ওই তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল একশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জ্যোর্তিবিদ্যায় অগ্রণী অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন লাইগো তিন বিজ্ঞানী। এদের একজন কিপ থর্ন যার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের একাধিকবার ইমেইল আলাপ হয়েছে।
মরা তারাদের মারামারিতে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার ঘোষণা আসার পর প্রতিক্রিয়া জানতে যোগাযোগ করা হয় কিপ থর্নের সঙ্গে। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) এই পদার্থবিজ্ঞানী বলেছেন, ‘আমি যারপরনাই অভিভূত’।
লেজার ইন্টারোফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি বা লাইগোতে কাজ করেন এক হাজারের বেশি বিজ্ঞানী। এদের মধ্যে ক্যালটেকেরই রয়েছেন অনেকে। এমনকি এবার যে তিনজন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন, সেখানে দুইজনই ক্যালটেকের বিজ্ঞানী। কিপ থর্ন ছাড়া অপরজন হলেন ব্যারি ব্যারিশ। নোবেলজয়ী ত্রয়ীর তৃতীয় বিজ্ঞানী হলেন রাইনার উইস যিনি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) পদার্থবিজ্ঞানী।
নতুন উৎস থেকে সৃষ্ট আইনস্টাইনের তরঙ্গ যে ধরা পড়েছে, এর কী তাৎপর্য জানতে চাওয়া হয় লাইগোর আরেক বিজ্ঞানী রানা অধিকারির কাছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন এই বিজ্ঞানী ক্যালটেকের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
ইমেইল সাক্ষাৎকারে রানা অধিকারি বলেন, ‘নতুন এই আবিষ্কারটা তাৎপর্যময়। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।’
উল্লেখযোগ্য যুক্তিগুলো কী?
অধিকারি বলেন, ‘এক. কীভাবে দূরের তারারা পরস্পর টক্কর খায়, এই আবিষ্কার সেই বিষয়ে গবেষণা করতে আমাদের সহযোগিতা করছে।’
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরার প্রয়াসে লাইগোর পাশাপাশি ইউরোপের ভার্গো ডিটেক্টরের ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি আরও ৭০টি আন্তর্জাতিক অবজারভেটরি নিউট্রন নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরা ও তা নিয়ে গবেষণায় সম্পৃক্ত রয়েছে।
নতুন আবিষ্কারের মূল্যায়নে দ্বিতীয় যে কারণটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অধিকারি তা হলো পার্থিব মৌলগুলোর উৎস। অধ্যাপক অধিকারির ভাষায়, ‘সোনা কিংবা ইউরেনিয়াম এরকম মৌলগুলো ঠিক কোথায়, কখন, কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জন্মবৃত্তান্ত বলে দিচ্ছে লাইগোর নতুন আবিষ্কার।’
লোহার চেয়ে ভারী মৌলগুলো কোথা থেকে পৃথিবীতে এসেছিল, এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরে ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। এবার তারই উত্তর মিলল যে, নিউট্রন নক্ষত্র বা মৃত তারাদের সংঘাতে এদের জন্ম হয়।
ড. অধিকারীর মতে তৃতীয় আরেকটি কারণ আছে যা নতুন আবিষ্কারটিকে তাৎপর্যপূর্ণতা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘মহাকর্ষ এবং আলোর তুলনা করে এই প্রথম মহাবিশ্বের প্রসারণকে বোঝার একটা উপায় বাতলে দিয়েছে এই আবিষ্কার।’
নিউট্রন নক্ষত্ররা এতই ঘন যে, এক চা চামচে এদের যতটুকু পদার্থ রাখা যায় তারই ভর হবে একশ কোটি টনেরও বেশি। পৃথিবী থেকে ১৩ কোটি আলোকবর্ষ দূরে এরকমই দুটো মৃত নক্ষত্রের সংঘর্ষ হয়েছিল। ১৩ কোটি বছর আগে আগে এদের মধ্যে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব ছিল।
ওই দুটো নক্ষত্রের একটির ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে সামান্য বেশি। আরেকটি সূর্যের চেয়ে দেড়গুণের কিছু ভারী। এদের সংঘর্ষে সৃষ্ট আইনস্টাইনীয় তরঙ্গকে বিজ্ঞানীরা প্রায় ১০০ সেকেন্ড ধরে দেখেছেন। পাশাপাশি একই ঘটনা বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দেখার পর দুই সেকেন্ড ধরে আলোর রূপে দেখেছেন। প্রথমে গামা রশ্মিরূপে এবং পরে রঞ্জন রশ্মিসহ আলোকের অন্যান্য রূপেও সেই সংঘাতের দৃশ্য ধরা পড়েছে লাইগোর চোখে।
কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুবই দুর্বল। এরা সাধারণত বস্তুর সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হয় না। ফলে আমাদের চারাপশে সব সময়ই থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের অনুভব করতে পারি না।
২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি লাইগো আনুষ্ঠানিকভাবে আাইনস্টাইনের তরঙ্গ ধরার কথা প্রকাশ করেছিল। তবে ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হচ্ছে ‘বিজ্ঞানের বড়দিন’, যেদিন জার্মানিতে গবেষণাকালে লাইগো ইতালীয় বিজ্ঞানী মার্কো ড্রাগো এই তরঙ্গ প্রথম অবলোকন করেন।