চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মন্দের ভালোর আশায় বেলা যে যায়

২০১২ সালে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম মাঠে ছিলো আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। স্থানীয় নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছিলো শাপলা চত্বর। তখন থাকতাম রাজশাহীর উপশহরে। একমাত্র হেফাজতকেই তখন আওয়ামী-বিরোধী প্রচারপত্র ঘরে ঘরে দিয়ে যেতে দেখেছি। ঘরে ঘরে একাধিকবার গিয়ে নানা রঙে শাপলা চত্বর কাণ্ডের সকরুণ বিবরণ দিতে দেখেছি তাদের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাবলিগী স্টাইলে ধরে ধরে মানুষকে সেসব শোনানোর দৃশ্যও দেখতে হয়েছে। শফি হুজুরের অনুসারীদের সেই ব্যাপক প্রচেষ্টার ফলাফল ভোটের দিন মিলেছে। ভোটের রাজনীতিতে হেফাজতীদের গুরুত্ব বোধহয় এর আগে কোনো নির্বাচনে এমন দগদগে হয়ে ফুটে ওঠে নি। কাজেই সেই হেফাজতকে বগলদাবা করে ভোটের ময়দানে গোল দেয়ার চিন্তা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হুট করে নিয়েছে বলে মনে হয় না।
২.
স্কুলের বইয়ে হেফাজতী প্রেসক্রিপশন প্রয়োগের পর এবার ভাস্কর্য সরাতেও তাদের দাবিই শিরোধার্য হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ নামের দলটির কাছে। বড় অদ্ভূতভাবে এই ইস্যুতে দা-কুড়াল একই গতিতে একসঙ্গে নামে-ওঠে। এই কাজকে জায়েজ প্রমাণ করতে আওয়ামী-বিএনপি দুপক্ষই প্রথমবারের মতো কোনো ইস্যুতে একমত। মনে রাখতে হবে, মেঠো কথা থেকে শুরু করে গোছানো লেখা- সবখানেই এমনভাবে আজকাল আলোচনা ওঠে যে, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি জিতে যাবে! আর সে কারণেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন দিতে ভয় পায়! তার মানে দাঁড়ায়, ক্ষমতার লড়াইটা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এখনো। এবার স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান দুটি দলই মনে করে, হেফাজতের এই দাবির বিরোধিতা করা উচিত নয়। কেন উচিত নয়, নিশ্চয় তার প্রধান কারণ ভোট! এইবার হিসাব মেলাই, ভাবি, এই বাংলাদেশে তাহলে সাধারণ মানুষের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যেতে হলে হেফাজতীদের লাগে! অভিন্ন কারণে জামাতকেও প্রয়োজন হয়! অথচ এখানে সেখানে আমি যে ফাল পাড়ি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ! কীসের কী! এতোগুলো দশক ধরে তাহলে আমরা সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারি নি। তার বড় প্রমাণ ধর্মের ভিত্তিতে এখনো ক্ষমতার ভাগাভাগি হয়
৩.
আমি হেফাজতের দাবি মানতে পারছি না। আমি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক মনে করি। বিএনপিকে চেখে দেখা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। গণআদালতের জরুরি সময়ে কক্ষচ্যূত আওয়ামী লীগ তাও মন্দের ভালো হয়ে অসাম্প্রদায়িকতার ছাতার পাহারাদার হিসেবে আমার মতো মানুষগুলোর ভোট পেয়েছে। কিন্তু এবার যে সব ছাড়িয়ে যাচ্ছে! তাহলে এবার কী হবে! আগামী নির্বাচনে কাকে ভোট দেবো! অসাম্প্রদায়িকতা আর প্রগতিশীলতার পালক নিয়ে এবার খুঁজছি একটা দল। কারণ আমি তো আর রাজনৈতিক কর্মী না! আমি স্রেফ সমর্থন করবো কাউকে! সে মন্দের ভালো হলেও চলে! আর সে কারণেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়ানো মানুষের অনুভূতির সাথে হয় মিশে যাবার জন্য কারো সঙ্গে আপোস করতে হয় কিংবা সরাসরি তাদের অনুভূতিকে দুয়ো দিতে দিতে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে হয়। সেই অনুভূতিগুলো, সেই চিন্তাগুলোকে সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে জনগণের শক্তি হাজির করার সামর্থ্য আমার নেই। কাজেই সারা পথ হেঁটে ভোটের আগে আমাকে ফের সেই মন্দের ভালোই বাছতে হয়। সেখানেই সিলটা মারতে হয়।
৪.
বাংলাদেশে তাহলে এতোসব অসাম্প্রদায়িকতার চেতনাচর্চাকারীদের সাফল্য কী? সাফল্য এটাই যে, এখনো হেফাজতীদের দাবির বিপরীতে “দুচারটে পোলাপাইন বিক্ষোভ করে। পুলিশের মার খায়, গরম জলে ভেজে, জেলে যায়। কিন্তু তারা কি শেষতক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে? নাকি ধর্মের দোহাইওয়ালারাই শেষমেশ তাঁদের আপন লোক হয়ে থাকে? গভীর অসুখের সময় মন্দের ভালো খুঁজবো, আর উপসর্গ যখন দেখা দেবে, তখন সেটাকেই মূল রোগ হিসেবে দৌড়ঝাঁপ করবো! এভাবে কি আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বাস্তবতা বিনির্মাণ করা যায়? রাষ্ট্রীয় শোষণ নিপীড়নের অভিন্ন চরিত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সময় পিছু হটবো, শিক্ষাব্যবস্থাটাকে গণমুখী করার প্রশ্নে উদাসীন থাকবো, দেশের সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ঘুমাবো, সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞায়নে নিজের কোলে ঝোল টানবো, দারিদ্র্য পয়দা করার কারখানাগুলোকে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে পৃষ্ঠপোষকতা করবো, মৌলবাদীদের অর্থনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা আর প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে ডাণ্ডা না ধরে ঠাণ্ডা থাকবো, আর এসবের উপসর্গগুলো যখন যখন আসবে, তখন চেতনা গেলো গেলো রব তুলবো! এভাবে আরো যতদিন চলবো, সাধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ক্রমেই দুঃস্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যাবে।
৫.
যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাই, তাহলে শহুরে হাওয়ায় রোগের উপসর্গের সঙ্গে সাপলুডু না খেলে একেবারে গ্রাম থেকে কাজটা শুরু করতে হবে। ধর্ম যার যার সমাজ সবার- সমাজের ভেতরে এই ধারণার ফলপ্রসূ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ধাপে ধাপে সেই সমাজের যুথবদ্ধতায় রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে। অর্থনৈতিকভাবে নতজানু আর অবরুদ্ধ মানুষকে পুঁজি করে ধর্মের অপব্যাখ্যা যতোটা ছেয়েছে, তা প্রতিরোধ করতে পারলে কোনো মন্দের ভালোর জন্য হা হুতাশ করতে হবে না। আজ যে ভোটের লোভ হেফাজত কিংবা জামাতকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, সেদিন সেই লোভের আগুনে তারা নিজেরাই ছাই হবে।
৬.
এতোসব যদি বুঝে থাকি, তাহলে সিদ্ধান্তটা আমার নেবার পালা, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময়ের অপেক্ষা করবো নাকি জেগে উঠে সময়টাকে নিজেদের কাছাকাছি আনবো।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)