ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মূল কার্যালয়ে মেয়র আনিসুল হকের কক্ষটির দরজা বন্ধ, সোনালি নেমপ্লেটে এখনো বড় করে লেখা মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিচে এখনো লেখা আছে আনিসুল হক।
নেমপ্লেটে এই নাম আর কয়েকদিন পর বদলে যাবে। কেবল এই কক্ষে এবং কক্ষের পাশে দায়িত্বপালন করা তার দুই ব্যক্তিগত সহকারির মনে প্রিয় মেয়রের জায়গাটিতে থেকে যাবে একটি নাম, আনিসুল হক। কারণ কার্যালয়ের প্রত্যেক কর্মীর মন জয় করেছিলেন মানবিক এই মেয়র।
কর্মী হিসেবে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মেয়রের এই মন জয় করার ক্ষমতার কথা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন প্রয়াত আনিসুল হকের ব্যক্তিগত সহকারি সৈয়দ আবু সালেহ ও রফিকুল ইসলাম।
মেয়র আনিসুল হকের পরিবারের জন্য এবার লন্ডনে যাওয়ার টিকিট কেটে দিয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত সহকারি (পিএ) সৈয়দ আবু সালেহ। জানতেন না প্রতি কর্মদিবসে যে তরতাজা হাসিমুখের মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সেই মানুষটি আর বসবেন না মেয়রের চেয়ারে, ডাকবেন না ফাইল নিয়ে আসতে।
আনিসুল হকের মানবিকতা তাকে কর্মীদের মনে মেয়রের চেয়েও বড় পদে বসিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,“আনিসুল হক স্যার মেয়র হয়ে আসলেন,আমরা ফুল দিয়ে বরণ করলাম। কিন্তু মনে ছিলো ভয়, নতুন মেয়র না যেনো কী হয়। তিনিও শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন আমরা ভয় পেয়ে দূরে থাকছি, মন খুলে কিছু বলতে পারছি না। এক মাসের মধ্যে তিনি এই ভয় কাটালেন।”
মেয়র থেকে তিনি আসলে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন জানিয়ে তিনি সালেহ বলেন,“স্যার আমাকে তুই করেই বলতেন। তাঁর দপ্তরে লোক ছিলাম আমরা মাত্র কয়েকজন। তিনি প্রচুর কাজ করতেন, আমাদেরও বাধ্য হয়ে করতে হতো। তবে সাধ্যমত চেষ্টা করতাম। তিনি কাজে খুশি হয়ে একবার বললেন, সালেহ তোর সাথে তো পারা যাবে না।”
জবাবে “আপনি যা শিখাইছেন তাই করছি” বলে মেয়রের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গিয়ে এক নতুন আনিসুল হককে আবিষ্কার করেন তিনি।
মেয়র রেগে গিয়েছিলেন জানিয়ে সালেহ বলেন,“স্যার প্রশংসা করায় তাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গিয়েছিলাম। স্যার তখন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন শুধু মা-বাবা আর আল্লাহর কাছে মাথা নিচু করবা। আমি তোমার বাবা না।”
অসুস্থ মেয়রের জন্য বার বার সবার দোয়া চেয়েছেন সালেহ,ভাবেননি কোনদিন ‘স্যার’ আর ডাকবেন না।
আজ এই চরম সত্যকে মেনেই অফিস করতে হচ্ছে বলতে গিয়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি মেয়র আনিসুলের এই কর্মচারি।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলেন,“আমার বাবা-মা বেঁচে আছেন। স্যারের মৃত্যুতে যে কষ্টটা পেয়েছি এটা হয়তো বাবা-মা’র মৃত্যুর কষ্টের মতোই। সকাল বেলা স্যারের রুমে গেছি, স্যার নাই। অসুস্থ বোধ করতে শুরু করায় প্রেশারের ওষুধ খেয়েছি।”
মেয়রের কক্ষে সার্বক্ষণিক সহায়তা করা রফিকুল ইসলামের স্মৃতিতে গেঁথে গেছে এবছরের রমজান মাসের ২০ তারিখ।
সেদিন অন্য এক আনিসুল হককে দেখেছিলেন তিনি, মানবিক মেয়র চলে গেছেন এই সত্য মানতে কষ্ট হচ্ছে তার। “আমার মনে হচ্ছে এইতো পাশের কক্ষেই আছেন স্যার।”
মেয়র আনিসুল হক কিভাবে মন জিতে নিয়েছিলেন, তা জানালেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বলেন,“সকালে এসেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খোঁজ নিতেন,কেউ দেরী করে আসলে পরিবারের খোঁজ নিতেন। আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করতেন। স্যার নিজের জন্য বাসা থেকে খাবার ও পানি নিয়ে আসতেন।”
নিজের মনে আনিসুল হকের জন্য শ্রদ্ধার ভিত্তি মজবুত করা একটি ছোট্ট স্মৃতি তুলে ধরে রফিকুল বলেন,“সেদিন ২০ রমজান, সাড়ে তিনটায় অফিস শেষ হলেও স্যার সেদিন বাড়িতে যাননি। বলেছিলেন অফিসের সবাইকে নিয়ে ইফতার করবেন। নিজে টাকা দিয়ে ইফতার আনালেন। আমি স্যারকে আলাদাভাবে ইফতার পরিবেশন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি বলেছিলেন মিটিং রুমে সবাই একসঙ্গে ইফতার করবো। স্যার আমার বস,আমি কোনদিন তাঁর সামনে চেয়ারে বসি নাই। সেদিন ইফতারে তাঁর সামনে চেয়ারে বসতে ইতস্তত করছিলাম। স্যারই আমাকে বললেন বসে ইফতার করো, সারাদিন রোজা রাখছো।”
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র। শনিবার দুপুর ১:০০টায় বাংলাদেশ বিমান এয়ালায়েন্সের ০০২ বিমানের একটি ফ্লাইটে তার মরদেহ ঢাকা আনা হয়। এরপরে শনিবার বাদ আসর আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে বিকাল ৫টার দিকে বনানী কবরস্থানে ব্যক্তি জীবনে সফল ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা আনিসুল হকের দাফন সম্পন্ন হয়।