বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে আন্ত:সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কারণ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাই সরকারের বিভিন্ন পোস্টে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রত্যেকটি সরকারের প্রধান হিসেবে রাজনৈতিক দলের প্রধানদের দেখে আসছি আমরা। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম সামরিক সরকার, সেনাবাহিনীর প্রধানরা সেনাশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশে যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে তাই রাজনৈতিক দলের নেতারাই সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে এবং ভবিষ্যতেও করে থাকবেন। কাজেই সরকার এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে সামঞ্জস্যতা রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোন শীর্ষস্থানীয় নেতা সরকারের দাপটে কোন অন্যায় কিংবা কাউকে অপদস্ত করে থাকলে তার দায় কোনভাবেই সরকার এড়াতে পারে না। বর্তমানে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তাই আওয়ামী লীগের কোন প্রভাবশালী নেতা দাপট দেখালে তার দায় সরকারের উপরেই বর্তায়।
সম্প্রতি ঢাকার শমরিতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়ে কলেজ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক এমপি এম মকবুল হোসেনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ আকারে দেখা দেয়। রোববার সকালে আট দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। আন্দোলনের যৌক্তিক দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের মতামত তুলে ধরে। আন্দোলনের সংবাদ পেয়ে কলেজ পরিচালনার কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক আওয়ামী লীগ এমপি মকবুল হোসেন শিক্ষার্থীদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এসময় তিনি বলেন, ধর্মঘট করলে আমার কোন সমস্যা হবে না। বেশ কটি মেডিকেল কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও বন্ধ করে দিব। তিনি পুলিশকে পাশে রেখে শিক্ষার্থীদেরকে হুমকি দিয়ে আরো বলেন, আমার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে সরকার। পাশাপাশি তিনি ছাত্রছাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
অন্যদিকে, সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার পরিবেশ দিনকে দিন মসৃণ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে সরকারী দলের সাবেক এমপি সরকারের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের শোষণ করার পায়তারা করে চলেছে। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়, কোন সভ্য মানুষ শিক্ষাকে পণ্যতে পরিণত করতে পারেন না।
কলেজ কর্তৃপক্ষের হুমকি ও অশোভনের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা উপায়ন্তর না দেখে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে ভেতরে রেখে বাইরে তালা মেরে দেয়। অবশেষে, বেলা আড়াইটার দিকে মকবুল হোসেন শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এখন প্রশ্ন হলো, জল যেহেতু খেতে হবেই, তাহলে ঘোলা করে খাওয়ার কী দরকার? শুরুতেই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলে ক্ষতি কী ছিল? মাঝখানে সরকারের প্রসঙ্গ টেনে এনে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটানোর সুযোগ নয় বৈকি? আসলেই কি সরকারের কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি মকবুল সাহেবকে পেছন থেকে সাপোর্ট দিয়েছেন? আমার মনে হয় না কেউ সাপোর্ট দিয়েছেন, তথাপি মকবুল সাহেবের উক্তি আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকর অবশ্যই।
সাম্প্রতিক সময়ে মকবুল হোসেনকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তেমন আর লক্ষ্য করা যায় না। ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য কেন সরকারকে তথা সরকারি দলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? নির্বাচনী বছর বর্তমান সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দলের প্রতি অন্ত:প্রাণ নেতাকর্মী কখনোই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করবেন না ঘুণাক্ষরেও। সেখানে মকবুল হোসেনরা শিকারীদেরকে শিকার করার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছে হরহামেশাই। দলীয় প্রধান যেখানে রাত দিন পরিশ্রম করে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন সেখানে আপনারা নেতারা সহযোদ্ধা না হতে পারলে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান কেন? তৃণমুলের কোন কর্মী আওয়ামী লীগকে কখনোই বিপদে ফেলে না। অথচ যারা নেতা তারাই সরকারকে নিজেদের সুবিধার জন্য বেকায়দায় ফেলার জন্য কর্ম করে যাচ্ছে। অথচ তারা একবারও ভাবে না, কোনভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় না থাকলে এ দেশটার কী হবে? কাজেই নেতাদের সাবধানে পা ফেলতে হবে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে। কোনভাবেই নিজের অপকর্মের জন্য দলীয় প্রধান তথা সরকার প্রধানকে বিচারের কাঠগড়ায় যেন দাঁড় করানো না হয় সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পথ চলতে হবে।
উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকের সংখ্যা অন্য যেকোন দলের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যান টানলেই সমর্থকদের বাস্তব চিত্র দেখা যাবে। তাহলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কিছু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কেন পরাজয়ের স্বাদ বহন করছে? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। সম্প্রতি রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ফলাফলও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক। কারণ, জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। এমন অবস্থায় নির্বাচনে জয়লাভ কর্মীদের নতুনভাবে উজ্জীবিত করবে। কারণ, আওয়ামী লীগের প্রাণ কর্মীরা। এ নির্বাচনে হারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো, দলীয় কোন্দল ও প্রভাব বিস্তারের সমন্বয়তা। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ সংসদ শামীম ওসমান ও আওয়ামী সমর্থিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে এবং মেয়র আইভীও আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে কয়েক রাউন্ড বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিকে নিয়ে আসতে হয়। ফুটপাতে হকার বসানোকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। একপক্ষ চায় হকার মুক্ত ফুটপাত, অন্যপক্ষ বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত ফুটপাতেই হকারদের রাখার পক্ষে। ক্রমশ বিষয়টা ব্যক্তিক দ্বন্দ্বে গিয়ে দাঁড়ায়। কোন পক্ষই কাউকে ছেড়ে কথা বলার নয়। আবার দু পক্ষই আওয়ামী লীগের। ঘটনার সুরাহা যাই হোক না কেন, কর্মীদের কিন্তু মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। এর ফলে বিরোধীপক্ষরা সহজেই নির্বাচনী মাঠ দখলের সুযোগ পাবে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। কারণ, নিজেদের মধ্যে অন্ত:কলহ বিরোধীদের রাজনৈতিক মাঠকে সহজ করে দেয়। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দলীয় কোন্দলের প্রভাব পড়তে পারে। দীর্ঘদিন ধরে শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত বিরোধ দলীয় কাঠামোতে এনে কর্মীদের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেওয়া সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে খুবই ক্ষতিকর যে কোন রাজনৈতিক দলের জন্য।
চার্চিল বলতেন, পাবলিক মেমোরি ইজ ভেরি শর্ট। অর্থাৎ বিগত ৪ বছরের উন্নয়নের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সরকার পরিচালনার সর্বশেষ ৬ মাসের যে কোন একটি ঘটনাকে মোক্ষম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এনে জনগণের মনোযোগে আকর্ষণ করাতে পারলেই বিরোধী দল নির্বাচনে পার পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং শেষ সময়টা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে ভোটের জন্য আরও তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগকে আরো বেশি সহনশীল ও নেতাদের দলের প্রতি আরও বেশি মনোসংযোগ ঘটাতে হবে দলের স্বার্থে, নির্বাচনে ইতিবাচক ফলাফলের স্বার্থে।
নিজদলের কর্মীদের মধ্যে মারামারি ও নেতাদের লাগামহীন কথাবার্তায় দলীয় প্রধানের বিগত ৪ বৎসরের অর্জনের কথা ভুলে গিয়ে দলের মধ্যে ভেদাভেদ ও শৃঙ্খলাহীনতা নির্বাচনে বিরূপ ফল নিয়ে আসতে পারে আওয়ামী লীগের জন্য। কাজেই নির্বাচনী বছরে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের আরো সহনশীল ও দলীয় প্রধানের নির্দেশমতো ৪ বছরের উন্নয়নের ফিরিস্তি জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। দল ক্ষমতায় না আসলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী নেতাদেরকে আর খোঁজে পাওয়া যায় না। তখন কর্মীরাই দলের ভরসা। অথচ দল ক্ষমতায় থাকলে কর্মীদের দ্বারা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়না সরকার তথা দল। পাশাপাশি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া উচিত। তা না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে আওয়ামী লীগের জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)