চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভিনদেশি চলচ্চিত্রে বিতর্কিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে কোন দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। তাই সিনেমা যেন সময় ও সমাজের সংলাপ, বিশ্বজনীন এক ভাষা। এ বছর বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্ণ করছে বাংলাদেশ। এদেশের আছে মুক্তিযুদ্ধের মতো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

দেশীয় চলচ্চিত্রগুলো তার ক্যানভাসে সে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার প্রয়াস দেখিয়েছে বেশ কয়েকবার। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ব চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রে ঠিক কতখানি জায়গা করে নিতে পেরেছে? কিংবা বিশ্ব চলচ্চিত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে সে বিষয়টিও অনুসন্ধানের সময় এসেছে।

সেই ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখা গেছে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট একেবারেই ধরা পড়েনি। হলিউডের মতো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।

হলিউডের বিশাল ক্যানভাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুয়ান্ডা গণহত্যা নিয়ে সিনেমা নির্মিত হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেখানে ঠাই পায়নি। বলিউড ও টালিউডে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এলেও সেখানে রয়েছে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ।

এখন পর্যন্ত ভিনদেশের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় আলী আব্বাস জাফর গুন্ডে (২০১৪), সংকল্প রেড্ডির দ্য গাজী অ্যাটাক(২০১৭),মৃত্যুঞ্জয় রায়ের চিলড্রেন অব ওয়ার ( ২০১৪) ,  সালমান রুশদীর উপন্যাস থেকে নির্মিত মিড নাইট চিলড্রেন (২০১২) ছবিতে। এছাড়া মানি শংকরের ডিসেম্বর সিক্সটিন ছবিটির নামও নেয়া যেতে পারে।

পাকিস্তানের চলচ্চিত্র বেশ সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছে ১৯৭১ সালকে । একাত্তর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম, রোমান্টিকতা কিংবা বাল্যবিবাহ।

১৯৭১-১৯৭৬ মধ্যে পাকিস্তানে দোস্তি, তেহজিব, বিয়ন্ড দ্যা লাস্ট মাউন্টেন ছবির নাম থাকলেও,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোথাও তুলে ধরা হয়নি।

সেই অর্থে বলিউডের গুন্ডে (২০১৪) ছবিতে দেখানো হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কলকাতাকে। একাত্তরের যুদ্ধে বাবা-মা’কে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে বিক্রম আরর বালা নামের দুই কিশোর। যুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের শহর কলকাতায় পাড়ি জমাতে বাধ্য করে।

গুন্ডে
গুন্ডে ছবিতে প্রিয়াংকা চোপড়ার সাথে অভিনয় করেছে রনবীর সিং, অর্জুন কাপুর

ছবির কাহিনীর সূত্রপাত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতা হলেও এলেও অ্যাকশন ধর্মী এ সিনেমায় যুদ্ধ সেখানে মূল উপজীব্য ছিল না। বরং তার ফ্রেমে ছিল কলকাতার সামাজিক জীবন ও মাফিয়া জগত।

গুন্ডের কাহিনীতে দেখানো হয়, ১৯৭১ সালে হিন্দুস্থান আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করে। আর এর ফলেই জন্ম হয় বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের। ছবিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যে বাংলাদেশের আপামর গণ মানুষের যুদ্ধ ছিল সেই বিষয়টিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে কৌশলে।

দ্যা গাজী অ্যাটাক (২০১৭)

দ্যা গাজী অ্যার্টাক
দ্যা গাজী অ্যাটাক-এ প্রধান চরিত্রে ছিলেন বাহুবলী’খ্যাত অভিনেতা রানা দাজ্ঞুবাত্তি

ছবিটি পুরোপুরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত না হলেও হিন্দি এ সিনেমাটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের এসে পাকিস্তান রীতিমত ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। শুরু হয় ইন্দো-পাক যুদ্ধের। সেই যুদ্ধে সাবমেরিন নিয়ে রওনা হয় ভারতীয় এক নৌ অফিসার আর তার দল। তাদের প্রায় ১৮ দিনের মতো পানির নিচে বাস করতে হয়েছিল।

চিলড্রেন অব ওয়ার ( ২০১৪)

children-of-war
চিলড্রেন অব ওয়ার ছবির একটি দৃশ্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের উপর নির্যাতনের নির্মম চিত্র নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় রায় নির্মাণ করেন ‘চিলড্রেন অব ওয়ার: নাইন মান্থস টু ফ্রিডম ছবিটি। যুদ্ধের সময় পাক হানাদার আর তার দোসরদের যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল প্রায় দুই লক্ষ নারীকে । ফলে যুদ্ধ শেষে জন্ম নেয় অসংখ্য যুদ্ধ শিশু। তবে ছবিতে ধর্ষণকে দেখানো হয়েছে এক ধরণের গ্ল্যামার সিম্বল হিসেবে । কিংবা করুণ সেই অবস্থার মানবিক প্রেক্ষাপট ও সংকটকে তুলে না ধরে নারী নির্যাতনকে দেখানো হয়েছে যৌনতার সুড়সুড়ি হিসেবে। ছবিটির প্রথম নাম ছিল দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড ।

মিড নাইট চিলড্রেন (২০১২)

মিডনাইট চিলড্রেন
মিডনাইট চিলড্রেনের একটি দৃশ্য

বুকার জয়ী সাহিত্যিক সালমান রুশদীর মিডনাইট চিলড্রেন উপন্যাস থেকে নির্মিত একই নামের সিনেমাটির প্রেক্ষাপট মূলত ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ভারত-পাকিস্তান পার্টিশন হলেও সেখানে খুব স্বল্প সময়ের জন্য এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের দৃশ্যও। ছবিটিতে যেমন ২৫ মার্চ কালরাতে জেনারেল জুলফির ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা দেখানো হয়েছে তেমনি আছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দৃশ্য। এমনকি মিডনাইট চিলড্রেনদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী শিবাকে বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা যায় ছবিটিতে।

ডিসেম্বর সিক্সটিন (২০০২) 

ডিসেম্বর সিক্সটিন (২০০২)
ডিসেম্বর সিক্সটিনের একটি দৃশ্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আছে- বলিউডের এমন আরেকটি চলচ্চিত্র হলো ডিসেম্বর সিক্সটিন। ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে দিল্লি শহর উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে বিপথগামী চার তরুণ। আর সেই গল্পই হয়ে যায় পরিচালক মনি শংকরের চলচ্চিত্র ‘ সিক্সটিন ডিসেম্বর’। ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি অনুপস্থিত থাকলেও ১৬ ডিসেম্বর তারিখটিকে উপস্থাপন করা হয়েছে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে। ছবিটির ভাষ্য অনুসারে পাকিস্তান ভারতের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করার ফলেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।

এই চলচ্চিত্র গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,

১। অধিকাংশ ছবিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দেখানো হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে।
২। মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশের মানুষের একটি গণযুদ্ধ হিসেবে না দেখিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতের বিজয়গাঁথা হিসেবে।
৩। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেও দেখানো হয়েছে পাকিস্তান কেবল ভারতের কাছেই পরাজিত হয়েছে।
৪। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণকে অস্বীকার করে এটাকে কেবল মিলিটারি যুদ্ধ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
৫। ‘ইন্দো-পাক যুদ্ধের ফলেই বাংলাদেশের জন্ম’-এমন একটি প্রপাগন্ডা প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে ছবিগুলোতে।
৬। ছবিগুলোতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের গৌরবোজ্জ্বল অবদান ছিল উপেক্ষিত। অধিকাংশ ছবি দেখে মনে হতে পারে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ধর্ষিত হওয়া ছাড়া বোধহয় আর কোন অবদান নেই।
৭। একাত্তরকে একটি স্বাধিকার আন্দোলন হিসেবে না দেখিয়ে কিছুক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের আরেকটি পার্টিশন হিসেবে। কিন্তু একাত্তর ছিল শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এটি কোন রক্তপাতহীন দেশভাগ নয়।