১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আগে থেকেই এই দিন পালিত হয় ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। বাংলাদেশে প্রায় দেড় যুগ ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এটিকে বাংলাদেশে বলা হয় ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’। বিগত কয়েক বছর ধরে দিবসটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক সময় ১৩ ফেব্রুয়ারী তথা পহেলা ফালগুনের চেয়েও ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’-এ তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। এই দিবসকে কেন্দ্র করে হাজারও তরুণ-তরুণীতে মুখোরিত হয়ে উঠছে পথ-ঘাট। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বসেছে তারুণ্যের মেলা। বন্ধু-বান্ধব, স্বামী-স্ত্রী,প্রেমিক-প্রেমিকা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পরস্পরকে জানাচ্ছেন ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।
এইদিন সকালে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল -বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। লক্ষ্য-বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে বিএনপি অফিসের হালচাল দেখা। ভেতরে প্রবেশ করেই দেখা গেল অসংখ্য নেতাকর্মী বসে আছেন। সাথে আছেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এ্যাডভোকেট রিজভী আহমেদ। প্রথমেই তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে কিভাবে দেখেন। তিনি এসব বাচ্চাদের ব্যাপার বলে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইলেন। বলেন, এবিষয়ে আমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। তবে ভালোবাসা বিষয়টি সার্বজনীন। আমরা দেশের মানুষকে ভালোবাসি। মানুষের জন্য ভালোবাসা থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছি। জন কিটস ভালোবাসা নিয়ে অসংখ্য কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তার কোনো লেখায় ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে তো কিছু পাইনি। ভালোবাসার জন্য কোনো দিবস পালন করা মানে ‘ভালোবাসা’কে অনিশ্চিত করে দেয়া। ভালোবাসার জন্য কোনো দিবস পালন করা মানে ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করা। ভালোবাসা সবসময় থাকতে হবে। কোনো একদিন দিবস পালন করা উচিত নয়। এটি ভালোবাসাকে বাণিজ্যিকিকরণ করছে বলে জানালেন তিনি।
বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মুহা রেজাউল করিম বিশ্ব ভালোবাসা দিবসই মানতে চান না। ‘আমি ভাই এসব দিবস-টিবস মানি না। এসব ভাবার সময় নেই। আর ভালোবাসা দিবস দিয়ে হয় না। ভালোবাসার জন্য মন লাগে। ভালোবাসা সবসময়, সর্বত্রই থাকতে পারে’।
মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সহ-সম্পাদক। তার কাছে ভালোবাসা দিবসকে কিভাবে দেখেন এবং এই দিবসে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি হারিয়ে গেলেন ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।
তিনি বলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারী আসলেই আমার ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারীর কথা মনে পড়ে যায়। ‘সেদিন কলা ভবন থেকে শিক্ষা ভবন অভিমুখে ছাত্রদের বিশাল মিছিল। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়. ‘সামরিক শাসন মানি না, মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল কর, করতে হবে’ স্লোগান চলছে এমন সময় হঠাত করেই গুলির শব্দ। প্রকম্পিত হয়ে উঠে চারিদিক। পুলিশ মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে শুরু করে ব্যাপক নির্যাতন। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের হিংস্র পুলিশ বাহিনীর উন্মত্ততায় একে এক লুটিয়ে পড়ে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা সহ নাম না জানা অনেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনেও গুলি টিয়ার সেলের আঘাতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নৃশংস হামলা। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা। বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়, জারি করা হয় কারফিউ। এটি ছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা বলেন, সেই দিন থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে ছাত্র জনতা ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি অনন্য দিন হিসেবে আজকেও আমরা দিবসটি পালন করেছি। সকালে শিক্ষা ভবনের সামনের স্মৃতি ফলকে ফুল দিয়ে স্মরণ করেছি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের। এসময় উপস্থিত ছিলেন জাসদ, বাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী সহ সকল ছাত্রসংগঠনের বর্তমান ও প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ। আমাদের সাথে ছিলেন ডাকসুর তৎকালীন ভিপি আমান উল্লাহ আমান, ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবির খোকন, ডাকসুর সাবেক এজিএম নাজিম উদ্দীন আলম সহ অনেকেই। সেদিন তারা যে কারণে জীবন দিয়েছিলেন তা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেছি আমরা। তাদের স্বপ্ন ছিলো দুটি- একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েম ও গণমুখী শিক্ষানীতি কায়েম করা।
স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ এর সাথে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’র কোনো দ্বন্দ্ব কি হচ্ছে না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এর সাথে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের কোন সম্পর্ক নেই। ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস আমাদের দেশের নিজস্ব দিবস। আমি মনে করি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে শফিক রেহমানের কোন ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলো না। এটি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
বাবুল বলেন, আমি মনে করি ভালোবাসা সর্বজনীন ব্যাপার। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, বন্ধু-বান্ধবদের ভালোবাসা, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততী, প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য, মানুষ-মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য, এবং সর্বপরি দেশের জন্য ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। বর্তমান সময়ে তো দেশের জন্য ভালোবাসা, মানুষের জন্য ভালোবাসার অভাব বোধ করছি খুব। মানুষ মানুষকে সহ্য করছে না আমাদের সমাজে। অমানিবকতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা আমাদের সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে আমাদের সকলের মধ্যে দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা জাগ্রত হোক এটাই প্রত্যাশা করি।
নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় যেভাবে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে আন্দোলন করেছিলেন, পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বিরাজ করতো তা কি আর ফিরে আসবে মনে হয় কখনা, এই প্রশ্নে বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বর্তমানে সেই অবস্থান নেই। ক্যাম্পাসগুলোতে অস্থিরতা। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন তাদের একক আধিপত্য বজায় রাখছে। বিএনপি বা ছাত্রদল সমর্থক ছাত্ররা নিয়মিত পড়ালেখা চালাতেও পারছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো ছাত্র রাজনীতির পীঠ স্থান। সেখানে সকল গণতান্ত্রিক দল তাদের কার্যক্রম চালাতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হতো। সকল অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করতো। বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সেই ঐতিহ্য হারিয়েছে। এর জন্য বর্তমান শাসক দলের ছাত্র সংগঠন দায়ী। শুধু ক্যাম্পাসই নয়। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই অবস্থা।
এই অরাজক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলেন বাবুল। তিনি বলেন, দেশের মানুষের সুখের জন্য, শান্তির জন্য এবং দেশের কল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। মানুষে মানুষে ভালোবাসা বৃদ্ধি করতে হবে। ভালোবাসাকে সর্বত্র বিস্তৃত করতে হবে। “এই ভালোবাসা দিবসে আমার সকল ভালোবাসা দেশের জন্য, দেশের মানুষ এবং সর্বপরি আমার দলের জন্যই থাকলো”