বৃষ্টি অনেকটা মেহমানের মতো। অতিথিপরায়ণ বাঙালি মেহমান দেখলে কত খুশি হয় তা নতুন করে বলার দরকার নেই। কিন্তু সেই মেহমান যদি দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অবস্থান করে? বিরক্তির সীমা থাকে না।
নাইম সাহেবের বাসায় একদিন গ্রাম থেকে মেহমান এলো। গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে। নাইম সাহেবের শ্যালকের বন্ধুর মামাতো ভাইয়ের ভাইস্তা। শ্বশুর পক্ষের আত্মীয় পেয়ে নাইম সাহেব বেজায় আনন্দিত। তারচে বেশি আনন্দিত নাইম সাহেবের স্ত্রী। আপন ভাইয়ের শ্যালকের বন্ধুর মামাতো ভাইয়ের একমাত্র ভাইস্তা বলে কথা। প্রথম দিন ব্যাগ ভর্তি বাজার আনলেন। পোলাও, মাংস, মাছ, কয়েক পদের পিঠা… যতভাবে পারা যায় আদর আপ্যায়ন করা হলো।
পরেরদিন আবার ভাত-মাংস, আলু ভাজি, দুই এক পদের পিঠা। মেহমান তো আদরে অভিভূত। নাইম সাহেবকে বললেন, ‘শুনেছি শহরের মানুষেরা স্বার্থপর হয়। মেহমান দেখলে বিরক্ত হয়। আপনারা হননি। আমার ধারণা পাল্টে গেছে।’
কিন্তু একদিন দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়। মেহমান যায় না। খায়, ঘুমায়। ফাইল নিয়ে কোথায় কোথায় ঘোরে। আবার খায়, ঘুমায়। যাওয়ার কোনো নাম নেই। মেহমানের জন্য আর আলাদা খাবার রান্না হয় না।
মেহমান বোঝে না সে তার মেহমানদারিত্ব হারিয়েছে। না বুঝলে তারে বোঝাবে কে। নাইম সাহেব স্ত্রীকে বলে শুধু ভর্তা আর সবজি রান্না শুরু করালেন। তেল, লবণ কম দিয়ে কড়া ঝালের তরকারি খেয়ে মেহমানের নাকের পানি চোখের পানি একাকার। তবু যাওয়ার নাম নেয় না।
ভারী বিপদ! বাধ্য হয়ে নাইম সাহেব স্ত্রীকে বললেন- ‘অ্যাই, চলো আমরা কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি।’ নাইম সাহেবের স্ত্রী তড়িঘড়ি করে বলল, ‘ঐ মেহমানও কি আমাদের সাথে যাবে?’
আমাদের অবস্থাও অনেকটা নাইম সাহেবের মতোই। নেচে গেয়ে, ডেকে ডুকে বর্ষা আনলাম। তপ্ত শহর, ধূলির শহর ভিজতে শুরু করলো হিমশীতল বৃষ্টির পানিতে। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। বৃষ্টিতে ভিজি। ছবি তুলি। সেই ছবি রোম্যান্টিক ক্যাপশনসহ ফেসবুকে পোস্ট দেই। যেন বর্ষার চেয়ে আনন্দের কিছু বাঙালি জীবনে নেই।
তারপর বৃষ্টি হয়ে যায় নাইম সাহেবের বাসার সেই মেহমানের মতো। ধূলি হয়ে যায় কাঁদা। বাসার সামনের নিচু রাস্তা হয়ে যায় ইংলিশ চ্যানেল। তখন আমাদের দুঃখ দেখে কে? অ্যাংরি রিয়্যাক্ট সম্বলিত স্ট্যাটাস দিয়েও বৃষ্টিতে তাড়ানো যায় না।
রবীন্দ্রনাথ ও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অতিমাত্রায় বৃষ্টিপ্রেমী। তাদের বৃষ্টি প্রেমী হওয়া সাজে। কেননা আগে বৃষ্টি মানে ছিল পেটভরা খিচুড়ি আর মনভরা রোমান্স। এখন বৃষ্টি মানে রাস্তাভরা পানি, পকেটভরা রিকশা ভাড়া, শহরভরা যানজট।
বৃষ্টির সুবিধা বেশি নাকি অসুবিধা বেশি? বিষয়টা ‘ডিম আগে না মুরগী’ আগের মতোই বহুল বিতর্কিত ও অমীমাংসিত। বিতর্কে না গিয়ে বরং বৃষ্টি নিয়ে একটা কৌতুক পড়া যায়।
দীর্ঘদিন চেষ্টার পর দারোগা বাবু চোরটাকে ধরতে পারলেন। চোর ধরে চোরের বাড়ি থেকে মাত্র রাস্তায় নেমেছেন ওমনি ঝুম বৃষ্টি। চোর বলল- ‘স্যার, একটু দাঁড়ান। আমার ঘরে নতুন ছাতা আছে। দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে ছাতাটা নিয়ে আসি।’ একথা শুনে দারোগা বাবুর মেজাজ দেখে কে? রেগে গিয়ে বললেন- ‘চোরের ঘরের চোর, আমাকে গাধা পেয়েছিস? ছাতা আনতে গিয়ে ভাগবি। তুই এখানে দাঁড়া। আমি ছাতা নিয়ে আসি।’
পুরান চাল ভাতে বাড়ে। পুরান কৌতুক কিসে বাড়ে জানি না। পুরাতন কৌতুকও বৃষ্টির মতো। বেশি হলে বিরক্ত সৃষ্টি হয়। বিরক্তি নামার আগেই বরং আরেকটা বৃষ্টির কৌতুক পড়ে শেষ করা যায়-
গভীর রাত। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। কেউ একজন চিৎকার করে বলছে, ‘এই যে ভাই, কেউ আছেন? একটু ধাক্কা দেবেন? এই যে ভাই…।’
চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল মিসেস মলির। মলি তার স্বামী রফিক সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘এই যে, শুনছো, কে যেন খুব বিপদে পড়েছে!’
ঘুমাতুর কণ্ঠে বললেন রফিক, ‘আহ্! ঘুমাও তো! লোকটার কণ্ঠ শুনে মাতাল মনে হচ্ছে।’ অভিমানের সুরে বললেন মলি, ‘মনে আছে সেই রাতের কথা? সেদিন তোমার কণ্ঠও মাতালের মতোই শোনাচ্ছিল।’
রফিক বললেন, ‘মনে আছে। সে রাতেও প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। তোমার খুব শরীর খারাপ করেছিল। গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেল। সেদিন আমিও চিৎকার করেছিলাম, কেউ আছেন? একটু ধাক্কা দিয়ে দেবেন?’
মলি বললেন, ‘মনে আছে তাহলে। সেদিন যদি তোমার চিৎকার শুনে একটা লোকও এগিয়ে না আসত, কী হতো বলো তো? আজ অন্যের বিপদে তুমি যাবে না? প্লিজ, একটু গিয়ে দেখো না!’
অগত্যা উঠতে হলো রফিক সাহেবকে। ভিজে চুপচুপা হয়ে কাদা-পানি মাড়িয়ে এগিয়ে চললেন তিনি শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। বললেন, ‘কোথায় ভাই আপনি?’ শুনতে পেলেন, ‘এই তো, এদিকে। বাগানের দিকে আসুন।’ রফিক সাহেব এগোলেন। আবারও শুনতে পেলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ…ডানে আসুন। নিম গাছটার পেছনে…।’ রফিক সাহেব আরও এগোলেন।
‘আহ্! ধন্যবাদ! আপনার ভাই দয়ার শরীর। কতক্ষণ ধরে দোলনায় বসে আছি, ধাক্কা দেওয়ার মতো কাউকে পাচ্ছি না!’ বলল এতক্ষণ ধরে চিৎকার পাড়া লোকটা।
লোকটা ধাক্কা দিয়েছিল না অন্য কিছু দিয়েছিল সেটা কেউ জানতে পারেনি। কেননা অন্যরা তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। বৃষ্টিতে আর যই হোক, ঘুম ভালো হয় একথা তো সবাই মানবে।
আগেরদিনে মানুষ ছিল প্রকৃতি নির্ভর। অতি খরায় ক্ষেতের ফসল পুড়ে যেত। এমনি এক খরার বছরে প্রথা অনুযায়ী দুই গ্রামের ব্যাঙদের ধরে ধরে বিয়ে দেওয়া হলো। ব্যাস। ব্যঙের বিয়ের আনন্দে আকাশ পাতাল একাকার করা বৃষ্টি। থামার নাম-গন্ধ নাই। বৃষ্টিতে ফসল ভালো হলো। কিন্তু বৃষ্টির জ্বালায় সে ফসল কাটার জো নেই। শুকানোর সুযোগ নেই। ফসল ভেসে যেতে লাগলো। উপায় না পেয়ে গ্রামবাসী ছুটলো সবচে বৃদ্ধ মানুষটার কাছে। তার বুদ্ধি পরামর্শ অনেক সময় কাজে লাগে।
গ্রামবাসী হাত জোড় করলো। বৃদ্ধ বাবা, দয়া করুন। একটা উপায় বাতলে দিন। এই বৃষ্টি থামানোর উপায় বলে দিন।
গম্ভীর গলায় বৃদ্ধ বললেন, ‘খরার সময় যে ব্যাঙগুলোর বিয়ে দিয়েছিলে, তাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো।’