বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম আর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি পায় স্বাধীন রাষ্ট্র, আমাদের লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন আর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, এসবই এক ও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো, সেই পলাশীর মাত্র ২৩ মাইল দূরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আরেক আম্রকাননে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার সেই অস্তমিত সূর্য আবার উদিত হলো। ১৯৭১ এর ১৭ এপ্রিল বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভিত্তিমূল রচিত হয়। ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৪ ও ৫-এ “বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র” শীর্ষক স্বাধীনতার সনদ সন্নিবেশিত রয়েছে। এই সনদ তৈরির পেছনে অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে যা তৎকালে সারা পৃথিবীর মানুষ অবগত হয়েছিলো। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে সমগ্র পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে এককভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীগণ জয়লাভ করেছিল। নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে পাকিস্তানি সামরিক চক্র পূর্ববঙ্গের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) নিরস্ত্র বাঙালি জাতির উপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের লেলিয়ে দেয়। এতে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। প্রায় এক কোটি বাঙালি সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএ-গণ সীমান্ত অতিক্রম করে কৌশলগত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন।
পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লিতে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী এমএনএ এবং এমপিএদের নিয়ে একটি গোপন স্থানে অধিবেশন আহ্বান করেন। এঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাঁদের ওই অধিবেশনের আইনগত ভিত্তি ছিল। এঁরাই গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
অধিবেশনে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যও নিযুক্ত করা হয়। এভাবে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনগণের সামনে মন্ত্রী হিসেবে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুদ্রিত রয়েছে। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের ভিত্তি।
১১ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ ১৪ এপিল প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বোমবর্ষণ করে। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে।
অন্যান্য প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ তৈরি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি। শপথ গ্রহণের স্থান গোপন রেখে সাংবাদিকদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে সবই ঠিক ঠিক সম্পন্ন করেছিলেন বাংলাদেশের অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকরা। যার ধারাবাহিকতায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।
সেদিন ছিল শনিবার। সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া পাহারায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালির উপচে পরা ভিড় চারদিকে। ঐতিহাসিক স্বাধীনতার মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬ টি চেয়ার। অনুষ্ঠানের প্রবেশ পথে বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’।
স্থানীয় সময় এগারোটা বেজে ৫০ মিনিটে আসে সেই মাহেদ্রক্ষণ। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাঁর পেছনে তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও জেনারেল এম এ জি ওসমানী।
অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরান তেলাওয়াত, গীতা ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী এবং হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এরপর নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ ও সেনাবাহিনীর প্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। পাক শাসকগোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেই ঘোষণা করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেদিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। শপথ গ্রহণের পর পরই শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। … পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে বলেন- ‘আমরা যা করছি সবই শেখ মুজিবের নির্দেশে। তবে তিনি কোথায় আছেন বলব না।’ আরো বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।… স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।’
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। তিনি জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল, সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। তার সঙ্গে আমাদের চিন্তার যোগাযোগ রয়েছে। আমরা জানতাম, বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দি। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাকিস্তানি বাহিনী বলুক, এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমরা যদি বলি, বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে, আর তারা যদি তা অস্বীকার করে; তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি, তিনি দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তখন হানাদাররা বলে বসবে, তিনি বন্দি আছেন।
এ অনুষ্ঠান থেকে নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান।
আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগান। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযোগে ফেরত পাঠানো হলো। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশন করেন।
মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রাক্কালে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল তার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে লেখা ছিল,‘‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান”।
ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘‘যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং উহা দ্বারা পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি।”
ঘোষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।
ইয়াহিয়া খান বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের মাটিতে বসেই। নতুন সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম স্থান পায়। এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি নয় মাস মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনেন মহামূল্যবান বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র যুদ্ধ আর আত্মত্যাগে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান দখল করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। তাই ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ধারাবাহিকতায় গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ছিল বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে একটি সাংবিধানিক সরকার বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
১৭ এপ্রিল মুজিব নগর দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই সরকারই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার। এই সরকার গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সকল প্রকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিচালনা করেছে দীর্ঘ নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকাণ্ডের যোগসূত্র হচ্ছে মুজিবনগর সরকার-ইতিহাস তার সাক্ষী। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর বৈদ্যনাথতলায় রচিত হয়েছিল আরেকটি অনন্য ইতিহাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)