বিয়ে বাড়িতে উচ্চস্বরে গান-বাজনার প্রতিবাদ করায় রাজধানীর ওয়ারীতে নাজমুল হক (৬৫) নামে এক অসুস্থ ব্যক্তিকে মারধর করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার দায় স্বীকারও করেছে হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ওই বিয়ের বরসহ ৪ জন। এ ধরণের শব্দ দূষণের ঘটনা থেকে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা সারাবছর ধরেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে তা গণমাধ্যমে এসেছে। পুরো রাজধানীতেই কোথাও না কোথাও শব্দের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে সবাইকে। রাজধানীবাসীর ঘুম ভাঙ্গে নির্মাণ কাজের বিকট শব্দ নয়তো যানবাহনের অযাচিত হর্নে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের দুইশ গজের মধ্যে এবং এক প্রতিমন্ত্রীর বাসভবন লাগোয়া অঙ্গন নামে একটি কমিউনিটি সেন্টারে নপ্তাহের অন্ততঃ দুইদিন উচ্চস্বরে গান-বাজনা এবং গভীর রাতে পটকা ও আতশবাজির ঘটনা পুরো এলাকার জন্য দূর্বিষহ হওয়া নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরও এ নিয়ে কাউকে গা করতে দেখা যায়নি। গণভবনের দুইশ গজের মধ্যে যদি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পটকাবাজি ও আতশবাজি করা যায় তাহলে অন্য জায়গায় কী ঘটছে সেটা সহজেই বোধগম্য। এ নিয়ে কাউকে যেনো বলারও কোনো সুযোগ নেই। অথচ দেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু আইন ও নীতিমালা রয়েছে, যার আওতায় রয়েছে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডসহ নানা সাজার ব্যবস্থা। নাগরিকদের অসচেতনতা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এসবের কোনো প্রয়োগ হচ্ছে না। হর্ন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে হাইকোর্টের আদেশে কিছু পদক্ষেপ আছে। তাছাড়া অন্য নানা মাধ্যমে চারপাশে মানুষজনকে বিরক্ত করে চলছে নানা ধরণের শব্দদূষণ। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দ দূষণ নীতিমালা করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। এছাড়াও নীরব ও বাণিজ্যিক এলাকার জন্য আলাদা আলাদা মাত্রা ধরা আছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় বলা আছে, আবাসিক এলাকার সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের ইট বা পাথর ভাঙার যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। যানবাহনে অপ্রয়োজনে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো যাবে না। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা যবে না। এই বিধির আওতায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের চতুর্দিকে ১০০ গজের ভেতরে কোনো প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না। এছাড়া বিয়েসহ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। সে নির্দেশনা মোতাবেক লাউড স্পিকার, এমপ্লিফায়ার বা কোনো যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে। এসব কার্যক্রম সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার বেশি হবে না। পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনোভাবেই শব্দ দূষণকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু আজকাল এ ধরণের আয়োজন হরহামেশা পাড়ামহল্লায় চলছে কোনো ধরণের অনুমতি ছাড়া ও সময়ের হিসেব না রেখে প্রায় সারারাত ধরে। বিষয়টি খুবই চিন্তার। যানবাহন, শিল্প-কারখানা থেকে বের হওয়া শব্দ এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের শব্দের তীব্রতা নির্দেশিত মাত্রায় বা তার নিচে বজায় রাখা উচিত। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকাসহ সামাজিক সচেতনতায় সরকারি-বেসরকারি সবার কাজ করা প্রয়োজন। শব্দদূষণের শিকার আশপাশে থাকা শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীসহ সবাই। ওয়ারীতে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হওয়া ওই ব্যক্তিও শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। শব্দদূষণের প্রতিবাদ করার কারণে তাকে জীবন দিতে হলো। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন কাজে শব্দের ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা কতটা মানবিক আচরণ করছি, তা ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া আইন প্রয়োগকারি সংস্থাগুলো ঘটনা ঘটার পরে অভিযোগ পেলেই কেন শুধু সক্রিয় হয়, এটাও দেখা জরুরি। উন্নত দেশগুলোতে এ ধরণের বিষয়গুলোতে সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কী করে, তা দেখে ও দেশের প্রচলিত আইনের বিধিবিধান অনুসারে ব্যবস্থা নিয়ে শব্দদূষণের মতো ঘাতক যন্ত্রণা দূর হবে বলে আমাদের আশাবাদ।