চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিষাদের কাব্য সিডনি অপেরা হাউজ

মানব সভ্যতায় যা কিছু সুন্দর, সব সুন্দরের সৃষ্টিতে বেদনার গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। কল্পনার সুন্দরকে বাস্তব রূপ দিতে স্রষ্টাকে যে বেদনার ভেতর দিয়ে যেতে হয় তা সবার চোখে পড়ে না। সব সুন্দর সৃষ্টিই মানুষের মনকে, দৃষ্টিকে নন্দিত করে, পেছনে পড়ে থাকে বেদনার ইতিহাস।

তেমনই একটি বিষাদের কাব্যের আরেক নাম সিডনি অপেরা হাউজ। অপেরা হাউজের একেকটি বৈশিষ্ট্য যেমন অপার বিস্ময় জাগানিয়া, তেমনি এটি এক মানুষের বিষাদেরও গল্প। নির্মাণে এতো সময় লাগছিলো এবং এর খরচও এতো বেড়ে যাচ্ছিলো যে, সরকার এক সময় অর্থ যোগান দেয়া বন্ধ করে দেয়। অপেরা হাউজের স্থপতি জর্ন অটজান অর্থের অভাবে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে নিজ দেশ সুইডেন ফিরে যান। নানা চড়াই উৎরাই পার করে দীর্ঘদিন পর এটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় কিন্তু অপূর্ব এই স্থাপনা নিজ চোখে আর দেখেননি জর্ন।

অপেরা হাউজের মূল নকশা

১৯৭৩ এটি যখন উদ্বোধন করা হয় সেই অনুষ্ঠানেও দাওয়াত পাননি তিনি। এমনকি কোথাও তার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন সিডনি অপেরা হাউজ উদ্বোধন করেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

জর্ন অটজান এ স্থাপনার স্বপ্নদ্রষ্টা হলেও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় এটি অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ মানুষের স্বপ্ন হয়ে ওঠে। এই একটি স্থাপনা অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিক, স্থপতি, প্রকৌশলী বিশেষ করে সাধারণ মানুষকে জীবনমুখী করে তোলে, তাদের স্বপ্নবান এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা করে তোলে। প্রাচীন এবং আধুনিক স্থাপত্য কলার মিশেলে তৈরী হয়েছে সিডনি অপেরা হাউজ।

সিডনির বেনেলং পয়েন্টে অপেরা হাউজটি নির্মিত। এর নকশা অনুমোদন পায় ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৬ সালে এটি নির্মাণের জন্য নকশা আহ্বান করা হয়। সারা বিশ্ব থেকে ২৩৩ টি নকশা জমা পড়ে। এ নকশাগুলোর মধ্যে থেকে সুইডেনের স্থপতি জর্ন অটজানের ডিজাইনটি চূড়ান্ত করা হয়। এ নকশার জন্য ৫ হাজার পাউন্ড পুরস্কার পান জর্ন।

স্থপতি জর্ন অটজান

অপেরা হাউজ নির্মাণে চার বছর সময় ধরা হয়। কিন্তু এটি নির্মাণে ১৪ বছর লেগে যায়। ১৯৫৯ সাল থেকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রায় ১০ হাজার কর্মী অপেরা হাউজটি নির্মাণ করেন। ১.৬২ হেক্টর জায়গাজুড়ে নির্মিত অপেরা হাউজের ছাদ তৈরিতে প্রায় ১০ লাখ টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। এই টাইলসগুলো বানানো হয়েছে সুইডেনে।

স্থাপনাটির ভেতরে রয়েছে ২,৬৭৯ সিটের কনসার্ট হল, ১৫০৭ সিটের আপেরা থিয়েটার, ৫৪৪ সিটের ড্রামা থিয়েটার, ৩৯৮ সিটের প্লে হাউস এবং ৪০০ লোক একসাথে কাজ করার মতো স্টুডিও। কনফিগারেশন পরিবর্তন করে এইসব হলের আয়তন ও সিট ক্যাপাসিটি বাড়ানো বা কমানো যায়। বছরে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এই অপেরা হাউজ পরিদর্শনে আসেন।

শিল্পী/পারফরমারদের স্বপ্ন থাকে এই স্টেজে দাাঁড়ানোর

থিয়েটার বা স্টেজ শো’র পাশাপাশি অপেরা হাউজটি ঘুরে দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। ছোট ছোট দল বা ব্যক্তি টিকিটের বিনিময়ে অপেরা হাউজ ঘুরে দেখতে পারেন। নবাগত পরিদর্শকদের অপেরা হাউজ দেখানোর জন্য বেশ কয়েকজন গাইড রয়েছেন। পরিদর্শনের সময় গাইডরা দর্শনার্থীদের এই স্থাপনা নির্মাণের ইতিহাসের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন।

গাইডদের মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন গাইডও আছেন

অপেরা হাউজে প্রথম অনুষ্ঠান করেন পল রবিনসন। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো এ স্থাপনাকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ লিস্ট’ এ তালিকাভুক্ত করে।

অপেরা হাউজের বাইরের দেয়াল

এর নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছিল ৭০ লাখ ডলার। কিন্তু নির্মাণ শেষে দেখা যায় এতে ১০ কোটি ২০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে। এই খরচের বড় অংশই বহন করেছে অস্ট্রেলিয়া সরকার।

১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে জর্ন অটজানের নকশা যখন চূড়ান্ত মনোনয়ন পায় তখন তার বয়স ছিলো ৩৮ বছর। নৌকার পালের মতো ঢেউ খেলানো নকশার এই অপেরা হাউজ আধুনিক স্থাপত্য কৌশলের ধারণাই পাল্টে দেয়। একটিমাত্র স্থাপনা অটজানকে ক্যারিয়ারের চূড়ায় নিয়ে যায়।

জর্ন অটজানের জন্ম কোপেনহেগেনে ১৯১৮ সালে। বেড়ে উঠেছেন আলবর্গ শহরে। তার বাবা পেশায় ছিলেন নেভাল ইঞ্জিনিয়ার। বাবার মতো অটজানেরও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পড়াশুনার জন্য তিনি স্থাপত্যবিদ্যাকে বেছে নেন। পড়াশুনা শেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তিনি সুইডেনেই কাজ করেন। তার কাজে সুইডেনের স্থপতি গানার আসপ্লান্ড এর প্রভাব দেখা গেছে। পরবর্তীতে আলভর অলটোর প্রভাবও লক্ষা করা যায।

অপেরা হাউজের দেয়ালের এই টাইলসগুলো বানানো হয়েছে সুইডেনে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিনল্যান্ডে খুব অল্প সময়ের জন্য জর্ন আলভরের সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে অটজান একটি অনুদান পান যার কল্যাণে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকো ভ্রমণ করেন। এই সফরের সময়েই তিনি সে সময়কার প্রভাবশালী স্থপতিদের কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান।

অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৫৯ সালের ২ মার্চ। কাজ শুরুর পর জর্ন পরিবারসহ সিডনিতে চলে যান। কাঠামো নির্মাণের পর ভেতরের মঞ্চ বা থিয়েটারের ডিজাইন কেমন হবে সে সম্পর্কে অটজানের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। কিন্তু ১৯৬৫ সালে এসে অস্ট্রেলিয়ার শ্রমমন্ত্রী ডেভিস জিউজস অপেরা হাউজের ভেতরের ডিজাইন সম্পর্কে বার বার প্রশ্ন করতে থাকেন। কবে এটার কাজ শেষ হবে, শেষ করতে আর কত অর্থ লাগবে এসব জানতে চান অটজানের কাছে। এক পর্যায়ে শ্রমমন্ত্রী অপেরা হাউজ নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেন। সে কারণে জর্ন বাধ্য হয়ে সব কাজ বন্ধ করে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইডেন ফিরে যান।

অপেরা হাউজের সবচেয়ে বড় স্টেজ

প্রধান স্থপতি হিসেবে অটজানের পদত্যাগে সিডনিবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তাকে ফেরত আনার দাবিতে সিডনির রাস্তায় বিক্ষোভও করেন তারা। কিন্তু কোন প্রতিবাদেই কাজ হয়নি। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে পিটার হল নামের আরেক স্থপতিকে অপেরা হাউজের ভেতরের অংশ ডিজাইন করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়।

এক সময়ে অপেরা হাউজ নির্মাণ শেষ হয়, কিন্তু নিজের সৃষ্টিকে কখনো নিজ চোখে দেখেননি জর্ন, যদিও সিডনি থেকে চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন দেশে অটজান বেশ কিছু স্থাপনার ডিজাইন করেছেন এবং সেগুলো সফলভাবে নির্মিত হয়েছে।

১৯৯৯ সালে জর্ন অটজানকে আবারো অপেরা হাউজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে অপেরা হাউজের নকশায় পরিবর্তন করতে একটি নির্দেশনাপত্র তৈরী করে দিতে রাজি হন জর্ন।
২০০৩ সালে অপেরা হাউজ তার ৩০ বছর পূর্ণ করে। সে বছরই জর্ন অটজান তার স্থাপনার জন্য স্থাপনা শিল্পের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘প্রিটজার প্রাইজ’ অর্জন করেন।

অপেরা হাউজে লেজার শো

পুরস্কার ঘোষণার সময় বিচারক এটি সম্পর্কে বলেন, জর্ন এমন একটি স্থাপনা নকশা যেটি নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছে সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকে। নির্মাণশৈলীও অনেক আধুনিক। এই একটি স্থাপনা একটি শতকের ভাবমূর্তিই পাল্টে দিয়েছে।

এখনও পর্যটকদের কাছে প্রথম দর্শনীয় স্থান সিডনি অপেরা হাউজ। এর ভেতরের থিয়েটার এবং স্টেজগুলোতে সারা বছরে প্রায় দু’ হাজার শো অনুষ্ঠিত হয়। দর্শক হয় প্রায় ১৫ লাখ।

২০০৬ সালে জর্ন অটজানের সহায়তায় অপেরা হাউজের পশ্চিম অংশের নকশা অনুযায়ী নতুন করে নির্মাণ করেন তারই পুত্র স্থপতি জেন অটজান। সে সময় বাবা সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমার বাবার বয়স এতো বেশী যে তার পক্ষে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকে অপেরা হাউজ। চোখ বন্ধ করলেই তিনি তার সৃষ্টিকে দেখতে পান।” এর ঠিক দু’ বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর পরপারে পাড়ি জমান দুনিয়াকে তাক লাগানো সৃষ্টির জনক জর্ন অটজান।

স্থপতি বাবা জর্ন অটজান এবং ছেলে জেন অটজান

সিডনি অপেরা হাউজ দীর্ঘদিনের চর্চায় সেখানকার মানুষের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এটা এখন তাদের সংস্কৃতির অংশ। প্রতিদিনের মঞ্চ নাটক বা দুনিয়াখ্যাত শিল্পীদের স্টেজ শো’র পাশাপাশি নববর্ষের প্রথম প্রহর উদযাপনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে সিডনির বেনেলং পয়েন্ট। এখানেই রয়েছে হারবার ব্রিজ। পুরো এলাকায় আলোকসজ্জার পাশাপাশি লেজার শো’র আয়োজন করা হয়। চীনা চন্দ্রবর্ষ উদযাপনেও এখানে লেজার শো’র আয়োজন করা হয়।

এসবের পাশাপাশি সিডনির সবচেয়ে উপাদেয় খাবারও পাওয়া যায় এখানকার রেস্টুরেন্টে। সিডনির সবচেয়ে নামী শেফরাই এখানে খাবার তৈরী করেন। এখানকার অপেরা কিচেনে রয়েছে মোট ৬০টি ডিশ।

বেনেলং পয়েন্টে নৌবন্দরের পাশে বসে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। নদীর পারে অপেরা হাউজের চারদিকেই আছে এই রেস্টুরেন্ট। হালকা খাবার, কফি, মিস্টান্ন সবকিছুরই ব্যবস্থা আছে সেখানে। তবে এখানে ভীড় এড়িয়ে ঘোরাফেরা করতে চাইলে শনি-রবিবার না যাওয়াই ভালো।