১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারে বিশ্ব খাদ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়-‘‘অভিবাসনে ভবিষ্যত বদলে দাও, খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াও’’ (চেঞ্জ দা ফিউচার অফ মাইগ্রেশন, ইনভেস্ট ইন ফুড সিকিউরিটি এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট)। খাদ্য দিবস উপলক্ষ্যে মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন। বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কৃষির উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমেই গ্রামীণ জনগণের জীবনমান এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
বিশ্ব খাদ্য দিবস আমাদের খাদ্য সার্বভৌমত্ব, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে চাল, মাছ, সবজিসহ প্রতিটি খাদ্যেরই দাম হু হু করে বাড়া এবং আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের খাদ্য সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে নানা শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তবে বলতে দ্বিধা নেই গত কয়েক দশকে আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। একই সাথে চাহিদাও বেড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন তিনগুণের বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন দশগুণ বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি, প্রণোদনা সহায়তা, সঠিকভাবে সার বিতরণ এসব কারণেই খাদ্য উৎপাদন বেড়ে চলেছে।
বর্তমানে দেশের আবাদী জমিতে বছরে গড়ে দুটি করে ফসল হচ্ছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা এখানে দারুণ সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। আবার স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ২ টন চাল উৎপাদন হলেও তা এখন দ্বিগুণে পরিণত হয়েছে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ। চাল উৎপাদনে সক্ষমতা দেখানোর কারণে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে শ্রীলংকাতে চাল রপ্তানিও করে। আর ২০১৫ সালে নেপালে ভূমিকম্প হলে সাহায্য হিসেবে ১০ হাজার টন চাল পাঠানো হয়।
সবজি উৎপাদনে আরো সামর্থ দেখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঙ্গের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। সারাদেশে বর্তমানে ৬০ ধরনের ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে মাছ উৎপাদনও বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ। আলু উৎপাদনেও বাংলাদেশে সাফল্য আরো বিস্ময়কর। দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭০ লাখ টনের মতো। সেখানে গত বছরে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৯৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর আলু উৎপাদন ১ কোটি টনের উপরে ছাড়িয়ে যাবে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানানো হয়।
তবে দেশে খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতির ধারাবাহিক চিত্র যখন এরকম তখন চালসহ খাদ্যের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ তার প্রয়োজনীয় বা চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে ধারাবাহিকভাবে চাউলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। চাল এখন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধিও কারণে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে প্রান্তজনেরা। যে প্রান্তজনেরা দেশের চরাঞ্চল, হাওর-বাওর, পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। যেখানে এখন দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি।
দেশের সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ যেসব মৌলিক অধিকার অনুসৃত রয়েছে তার সবগুলো থেকেই দেশের চর, হাওর, পাহাড়, উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত প্রান্তজনেরা সম্পূর্ণরুপে বঞ্চিত। এই বঞ্চনা একদিন নয়, দীর্ঘদিনের। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, শক্তিশালী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড না থাকা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং ধারাবাহিক দুর্যোগপ্রবণ হওয়ার কারণে এসব অঞ্চলে বসবাসরত মানুষকে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এবছর বন্যায় চরাঞ্চল, হাওরের কয়েকলক্ষ হেক্টও জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
চর, হাওর, পাহাড়, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনে যে অসংখ্য সমস্যা বিদ্যমান তার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা। খাদ্যের স্বল্পতা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয়ের অক্ষমতার কারণে এসব অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষকে বছর ধরেই একধরনের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্যচাহিদা কখনই তারা পূরণ করতে পারে না। ক্ষুধা নিবারণে ব্যর্থ হয়ে এসব অঞ্চলের অনেক মানুষ তাই শহরমুখী হয়ে পড়ে। শহরের বিভিন্ন জায়গাতে এসে তারা আশ্রয় নেয়।
বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট মধ্যে অন্তত ৩ কোটি মানুষ আছে যারা প্রতিদিন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিইএফপি) কর্তৃক নির্ধারিত ১৮.০৫ কিলোক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। চাহিদার তুলনায় এই খাদ্য গ্রহণ কোনোভাবেই একজন মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। সেই হিসেবে দেশের দারিদ্র্য পকেট বলে অভিহিত অঞ্চলে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষই যারা অতিদরিদ্র বলে পরিচিত তারা ডাব্লিউএফপি নির্ধারিত ক্যালরির নিচে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। নদী ও জীবন প্রকল্পের গবেষণায় দেখা যায়, চরাঞ্চলের হতদরিদ্র লোকগুলোর একটা অংশ সারাবছর একবেলা খেয়েই জীবনধারণ করে এবং আরো ভয়ানক চিত্র হলো, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এসব চরের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীই একবেলার বেশি পেটপুরে খেতে পায় না। দুর্গম চরের মাত্র ১০ ভাগ পরিবার সারা বছর তিনবেলা খেতে পায়। বছরের অর্ধেক সময় তিনবেলা খেতে পায় মাত্র ২৫ শতাংশ এবং প্রায় সারা বছরই কম-বেশি খাদ্য কষ্টে থাকে প্রায় ৬৫ ভাগ পরিবার। একই চিত্র হাওর এবং পাহাড়ি এলাকাতেও দৃশ্যমান।
এসব অঞ্চলে বসবাসরত অতিদরিদ্র মানুষ তিনবেলার পরিবর্তে দুবেলা খাদ্য গ্রহণ করে এবং যে পরিমাণ বা যে মানের খাদ্য গ্রহণ করে তা মোটেও পুষ্টি সমৃদ্ধ নয়। বেশিরভাগ মানুষ শাকসবজির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমিষের সামান্য চাহিদাও তারা পূরণ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আবার সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা বঞ্চনার শিকার হয় কিশোর-কিশোরী এবং শিশুরা। খাদ্য চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বেশিরভাগ নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা পুষ্টিহীনতাসহ নানা ধরনের রোগব্যধিতে ভুগে থাকেন।
চরসহ হাওর-বাওর, পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের বছরের পর বছর ধরে যে খাদ্যবঞ্চনায় ভুগে থাকে তার পেছনে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো- স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনমূখী কার্যক্রমের অভাব, ভূমিতে অতি-দরিদ্র মানুষের অধিকারহীনতা বিশেষ করে খাসজমি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের দখলে চলে যাওয়া, সারা বছরে স্বল্প সময়ের জন্য কৃষি উৎপাদনের সুযোগ, উৎপাদিত ফসলের গুনগতমান কম, উৎপাদন উপযোগী জাতের প্রচলনের অভাব, ব্যাপক আকারে কর্মহীনতা ইত্যাদি।
চরসহ হাওর-বাওর, পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুধাবঞ্চনা নিরসনে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে নানান ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা ও বিশ্লেষণপূর্বক ভিন্ন কৌশল, পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যা থেকে চরসহ হাওর-বাওর, পাহাড়ে হতদরিদ্র মানুষেরা ক্রমশই উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে, সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচন প্রয়োজন। একই সাথে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি বৃদ্ধি এবং খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার বিপনন সহজতরো করে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা।
খাদ্য প্রাপ্তি মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে খাদ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- যেখানে দেশের জনগণ তাদের আয়ের বেশীরভাগ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হল সকল সময়ে সবার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব সকল নাগরিকের খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। সরকারের কার্যবিধি অনুযায়ী জাতির জন্য একটি নির্ভরযোগ্য খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত। ১৯৯৬ সালের বিশ্ব খাদ্য শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সংজ্ঞা অনুযায়ী সকল সময়ে সকল নাগরিকের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় খাদ্য প্রাপ্তির ক্ষমতা নিশ্চিতকল্পে সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটাতে সরকার নানামুখী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। খাদ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো, প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানী, বিপনন এবং সরবরাহে সরকার সক্রিয় এবং যথেষ্ট সতর্ক। কিন্তু চরসহ হাওর-বাওর, পাহাড়ে বসবাসরত মানুষ দূরবর্তী স্থানে বসবাস করায় অনেকটাই চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এই সব মানুষগুলোর প্রতি অবশ্যই আলাদা দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। গ্রামীণ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াও বলে যে শ্লোগান দেওয়া হয়েছে সেটাকে অবশ্যই চরসহ হাওর-বাওর, পাহাড়ি এলাকায় নিতে হবে। এসব এলাকায় নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তির সম্মিলন ও ব্যবহার ঘটানো গেলে বিপুল খাদ্যচাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)