সাংবাদিকতা ছেড়ে শিক্ষকতায় এসে চোর ধরার কাজ করতে হবে ভাবিনি। অথচ গত কদিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে ভর্তি হতে আসা বড় বড় ‘চোর’ ধরার কাজই করলাম। পরীক্ষার হলে প্রতিবছরই কিছু দুর্বৃত্ত পরীক্ষার্থী ধরা পড়ে, কিন্তু এবার যা হল, এক কথায় নজিরবিহীন। মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে মার্কসহীন ভাইভা দিতে এসে আমার হাতেই ধরা পড়েছে তিন জালিয়াত। বিভাগে ভর্তি হতে এসেও যে বিভাগীয় কমিটির কাছে অনেকগুলো জালিয়াত ধরা পড়বে একদমই ভাবনায় ছিল না। ভর্তির সময় বিভাগে ধরা পড়েছে ৪ জালিয়াত। প্রতিটি জালিয়াত ধরার প্রক্রিয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। একে আমি আমার বা আমাদের সাফল্য মনে করছি না; বরং ভেবে কুল পাচ্ছি না, কীভাবে এই জালিয়াতগুলো এতগুলো কঠিন পর্যায় পার হয়ে প্রায় ভর্তিই হয়ে যাচ্ছিল!
প্রায় সবগুলো জালিয়াতির ঘটনায় দেখা গেছে, ভর্তি হতে আসা দুর্বৃত্ত শিক্ষার্থীগণ নিজেরা পরীক্ষা দেয়নি, ওদের হয়ে একদল ‘ভালো’ ছাত্র পরীক্ষা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেছে। পরীক্ষা দিয়ে চলে যাওয়া দুর্বৃত্ত পরীক্ষার্থীদের ‘ভালো ছাত্র’ বললাম এই কারণে যে, ধরা খাওয়া প্রতিটি ছেলের পজিশন ছিল উপরের দিকে, এক থেকে ৩০ এর মধ্যে। ভর্তি হতে এসে আটক হওয়ার পরে আবার একই প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হলে এরা কেউই পাশ মার্কসও পায়নি। প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিচ্ছে এমন শিক্ষার্থী মিলে এবার জাহাঙ্গীরনগরে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি। বরাবরের মত এবারো জাহাঙ্গীরনগরে প্রশ্ন ফাঁসের মত কোনো ঘটনা ঘটেনি, বরং দশ দিনের ভর্তি মহাযুদ্ধে কয়েকজনকে জালিয়াতি চেষ্টার অভিযোগে পরীক্ষার হল কিংবা বাইরে থেকে আটক করে পুলিশে দিতে সক্ষম হয় প্রক্টরিয়াল টিম। এরপরেও যে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ‘মেধাবী’দের মধ্য থেকে অনেককে চোর হিসেবে ধরে পুলিশে দিতে হবে আমরা কেউই হয়ত ভাবিনি।
অপরাধী ধরার কাজ পুলিশের। শিক্ষকের কাজ জ্ঞান বিতরণ করা; এমনটাই সভ্য সমাজের স্বাভাবিক ভাবনা। উন্নত, সভ্য বিশ্বে পরীক্ষার হল কিংবা ভর্তি প্রক্রিয়ায় এমন চোর ধরার ঘটনা ঘটে কি না, আমার জানা নেই। তিনদিনের (১২-১৪ নভেম্বর) মার্কসবিহীন ভাইভাতে সি-ইউনিটের ডিন’স কমিটিতে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। প্রথম দুইদিন জালিয়াত ধরা পড়েনি সি ইউনিটে। শেষের দিন শেষ এক ঘণ্টায় তিনজনকে ধরে কলা ও মানবিকী অনুষদের সম্মানিত ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক মহোদয়ের কাছে দিয়ে আসি। এদেরকে দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রক্টর অফিসে প্রেরণ করেন তিনি।এরপর ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেও যে অনেকে জালিয়াত হিসেবে শিক্ষকদের হাতে ধরা পড়বে, এমন ভাবাটা একজন শিক্ষকের পক্ষে খানিকটা অস্বাভাবিক বৈকি। সমাজ যে এত পচে গেছে, সেটি গবেষণা ও ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পক্ষে ধারনা করা কঠিন। ভর্তি হতে আসা এক ছাত্রকে দেখেই আমার সন্দেহ হল। সিগারেট খেয়ে ঠোট কালো করে ফেলেছে, মুখে কালো কালো দাগ, চুল উস্কখুস্ক। সহকর্মীদের বললাম আমার সন্দেহের কথা। হাতের লেখা দেখা হল। ওএমআর ফরমের সাথে বর্তমান হাতের লেখার একেবারেই মিল নাই। ঢাকার মাইলস্টোন কলেজের ছাত্র রিমন। কলেজের ছাত্র, কিন্তু চেহারা হল জীবন-যুদ্ধে হেরে যাওয়া বখাটে ছেলের মত। সবচেয়ে বিস্ময়কর, প্রবেশপত্রের ছবি দেখে মনে হবে, কত সুন্দর একটা ছবি! মুখের দাগ, হতাশা সব উধাও! চেহারায় মিল আছে। কিন্তু একটু সন্দেহমাখা মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বুঝবেন, ছবির রিমন আর বাস্তবের রিমন এক নয়।
ক্যাম্পাসে বহুল আলোচিত জালিয়াত খায়রুল ইসলামকেও বিভাগ থেকে আমরা ধরেছি হাতের লেখা ও ছবি মেলেনি বলে। সাতক্ষীরার আশাশুনির কৃষক বাবার সন্তান খায়রুল ইসলাম যখন বিভাগের সভাপতির কক্ষে আসল, তখন আমি চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিলাম। ক্লান্ত লাগছিল। কাল একটা জালিয়াত ধরেছি, আজ আবার কেউ আসবে, এমনটা ভাবনায় ছিল না। প্রতিদিন বিভাগে ভর্তি হতে আসা শিক্ষার্থীদের কাউকে জালিয়াত হিসেবে ধরা যাবে, এমন ভাবনা স্বাভাবিকতা নয়। চোখ বন্ধ করে খায়রুলের কথা শুনছিলাম। খায়রুল একটু বেশি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করছিল, অথচ প্রতিটি কথায় আনস্মার্টনেস ফুটে উঠছিল। কোন রুমে পরীক্ষা দিয়েছিল খায়রুল, এটা জানতে চাইলেন সহকর্মী শিক্ষক। খায়রুল ভবনের নাম, রুম নং, শিফট ইত্যাদি সব মুখস্ত বলে দিল। আমি চোখ খোলে তাকালাম। খায়রুলের দিকে চোখ রাখলাম। জুতা, প্যান্ট-গেঞ্জি, চোখ, চুল খেয়াল করলাম। খায়রুলের প্যান্ট-জুতা-গেঞ্জিও খুব অদ্ভুত রং এবং ডিজাইনের।
খায়রুলের প্রবেশপত্র আর সাথে করে নিয়ে আসা ছবি মিলিয়ে দেখলাম। মিল পেলাম না, সহকর্মীরাও সায় দিল। একটু পর বিভাগের স্টাফরা খায়রুলের সাথে থাকা প্লাস্টিক ফাইল থেকে আরও তিন রকমের ছবি বের করে নিয়ে আসল। হাতের লেখার একটা একটা করে অক্ষর আমরা সবাই মিলিয়ে দেখলাম। ওএমআর ফরমের হাতের লেখা একরকম আর খায়রুলের হাতের লেখার আরেকরকম। আমাদের কোনো সন্দেহ রইল না। আমরা তাকে সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের ডেকে ডিন অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। এই খায়রুল পরে তিনদিন ক্যাম্পাসে অবস্থান করেছে।তিনদিন অবস্থানকালে খায়রুল ক্যাম্পাসে আরামে ঘুমিয়েছে, খেয়েছে। ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, খায়রুলের সাথে আমরা ‘অন্যায়’ করেছি। এবং সে মোতাবেক ফোন আসতে শুরু করেছিল বলে জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক। খায়রুল ক্যাম্পাসে গুজব ছড়িয়েছিল, ওর চোখে চশমা ছিল না বলে আমরা ওকে ‘হ্যারাজ’ করছি! ওর কথা প্রমাণ করার জন্য গরীব বাবাকে দিয়ে সে শীতের রাতে আশাশুনি থেকে চশমা আনিয়েছে ক্যাম্পাসে! কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম, খায়রুল জালিয়াত। ছোট জালিয়াত না, বড় জালিয়াত। আমরা খায়রুলকে ডিন অফিসে প্রেরণ করলেও তাকে পুলিশে দেয়া হয়নি প্রথমবার। দ্বিতীয় বারের মত আবারো তাকে চেক করার জন্য বিভাগে পাঠানো হল। আমরা বিভাগ থেকে চিঠি লিখে আমাদের বক্তব্য জানালাম।
এরপরেও তাকে পুলিশে না দিয়ে ডিন স্যার কেন্দ্রীয় ডিন কমিটির মিটিং ডাকলেন। মিটিং এ উপস্থিত ইতিহাসের অধ্যাপক আতিক স্যারের নেতৃত্বে উপস্থিত কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষক খায়রুলের হাতের লেখা মিলিয়ে দেখে তার জালিয়াতি নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তবে আমরা নিশ্চিত হলেই তো কাজ শেষ না। খায়রুলের স্বীকারোক্তি পাওয়ার পরেই কেবল তাকে পুলিশে দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে সে কাদের আশ্রয়ে ছিল, কারা তাকে এত সাহস দিয়েছে? খায়রুল একটু ভয়ও পায়নি। খুব ঠাণ্ডা মাথায় বারবার বলে গেছে, পরীক্ষা সেই দিয়েছে!
কাউকে সন্দেহ করা সহজ কাজ। সন্দেহ আমরা হরহামেশাই করি। কিন্তু সন্দেহ করে সন্দেহভাজনকে অপরাধী প্রমাণ করা সহজ নয়। তাই সন্দেহ করার আগে নিশ্চিত হতে হয়। আমাদের ভুলের জন্য যদি কোনো ছাত্র/ছাত্রীর জীবন নষ্ট হয়, তাহলে উল্টো বিপদে পড়তে হতে পারে। আমার ধারনা, জালিয়াত ধরার কাজে একের পর এক সাফল্য কারও কারও মনে ‘বিরক্তি’, বা ঈর্ষার সৃষ্টি করেছিল। তাই এই অংশটি প্রার্থনা ও চেষ্টা করছিল, খায়রুল যেন জালিয়াত প্রমাণ না হয়, সেজন্য। ধন্যবাদ ডিন স্যারকে, ধন্যবাদ সেদিন মিটিং এ উপস্থিত সকল সহকর্মীকে, একটা বড় জালিয়াত ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করার জন্য।
ভর্তি পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। খায়রুলের মত জালিয়াতদের পক্ষে কেউ না কেউ পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু আমরা তাদের ধরতে পারিনি। এমন একটা নিয়ম করতে হবে যাতে প্রকৃত ভর্তিচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীরাই পরীক্ষার হলে উপস্থিত থাকতে বাধ্য হয়। কী হতে পারে সেই পদ্ধতি? জাহাঙ্গীরনগরের বর্তমান-সাবেক অনেক ছাত্র-ছাত্রী বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালুর পরামর্শ দিয়েছেন। কী পদ্ধতিতে জালিয়াতি ঠেকানো যায়, এর উপায় বের করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। বর্তমান পদ্ধতি নিয়ে যে ভাবতে হবে, সেটি বলাই বাহুল্য। পদ্ধতিতে দুর্বলতা আছে বলেই ভর্তি পরীক্ষা হলে, ভাইভার সময়ও জালিয়াতগুলো ধরা পড়েনি, ধরা পড়েছে ভর্তি হতে এসে। তবে একটা কথা বলে নেয়া ভালো, কোনো ধরনের প্রাযুক্তিক কারণে এরা ধরা পড়েনি। হাতের লেখায় বৈসাদৃশ্য পেয়ে আমাদের কোনো কোনো শিক্ষক জালিয়াতগুলোকে আটকে দিতে পেরেছেন।
আমরা প্রতারকগুলোকে ধরে পুলিশে দিচ্ছি। কিন্তু পুলিশ পরে করছে কী? নানা সূত্রে খবর পেয়েছি, পুলিশ এক দু’দিন রেখে ছেড়ে দিচ্ছে। যাদেরকে আদালতে পাঠাচ্ছে, সেখানে তারা জামিনে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। যারা প্রক্সি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, তারা তো গ্রেপ্তারই হচ্ছে না। পুলিশের কাজ তো আমরা করে দিতে পারব না। পুলিশ ইচ্ছে করলে কী না পারে! বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা দিচ্ছে। মামলা আদালতে চলে বহুদিন। একটা মামলার পেছনে সাধারণ আদালতে অনেক সময় দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতির জন্য একটা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করলে এই সম্যসার সমাধান হতে পারে। পুলিশের বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অপরাধীদের দ্রুত বিচারে সাজা হলে এ সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে বলে আমার ধারনা। আর প্রক্সি দাতাদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে অপরাধীদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গ্রুপকে সম্প্রতি সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে। এরা জালিয়াতি করে ভর্তি হয়েছিল, আবার অনেককে ভর্তি করিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রবেলায় দেখেছি, ভুয়া ছাত্র হিসেবে অনেকে ধরা পড়েছে। গত কয়েকবছরে পরীক্ষার হল থেকে যেসব প্রক্সিদাতাকে জাহাঙ্গীরনগরে আটক করা হয়েছে, তার অধিকাংশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও এই অপরাধী সিন্ডিকেটের সদস্যরা আছে। গতবার ছাত্রলীগের নেতাকে মামলা দিয়ে পুলিশে পর্যন্ত দিতে হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর থেকে। হল পর্যায়ের সে ছাত্রলীগ নেতার ব্যাংক একাউন্টে সাত লাখ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। পুরো অপরাধী চক্রকে নির্মূল করে দিতে হলে অন্তত এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের মধ্যে শক্ত বোঝাপড়া লাগবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও পুলিশের ডিবি বা সিআইডির মধ্যে সমন্বয় করে একটা টিম বছর জুড়ে কাজ করলে আরও অনেক অপরাধী ধরা পড়বে, আর আগে থেকেই প্রক্সি জালিয়াতি বা প্রশ্নফাঁসের মত ঘটনা ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, যারা ভর্তি হয়ে গেছে, তাদের কাগজপত্র, হাতের লেখা পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হোক, সব বিভাগে সমান মনোযোগ দিয়ে হাতের লেখা বা ছবি মিলিয়ে দেখা হয়নি বলে ক্যাম্পাসে একটা গুঞ্জন রয়েছে। বলা যায় না, পুনরায় দেখা হলে, আরও জালিয়াত ধরা পড়ে যেতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। )