চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় পিডিবি, ভোক্তারা বলছে অযৌক্তিক

আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো)। সংস্থাটি  পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৮৭ পয়সা হারে বাড়াতে চায়। আর বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ণ কমিটি বলছে, ৮৭ পয়সা নয় ৫৭ পয়সা বাড়ানো যায়।

তবে এই মূহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠনসহ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি দাম বৃদ্ধি নয়, কমাতে হবে।

সংগঠনগুলোর নেতারা বলছে, বর্তমানে চালের দাম উর্ধ্বগতি, বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে তেলের দাম বেশি, অনাকাঙ্খিত রোহিঙ্গা সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলা করছে দেশ। বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়ালে প্রত্যেক পণ্যে এর প্রভাব পড়বে। তখন মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। অতএব এই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নাই। বরং উৎপাদন যেহেতু বাড়ছে দাম কমানো উচিত বলে মনে করেন তারা।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য সোমবার রাজধানীর টিসিবি ভবনে বিইআরসিতে গণশুনানির আয়োজন করা হয়। সেসময় দাম বাড়ানোর পক্ষে-বিপক্ষে সংশ্লিষ্টরা এসব যুক্তি তুলে ধরেন।

বিউবো চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দেয় বিইআরসিতে। তখন ৭২ পয়সা হারে বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। এরপর বিগত কয়েকমাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ৮৭ পয়সা হারে বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ

শুনানিতে দাম বাড়ানোর যুক্তি তুলে ধরে বিউবোর জিএম (বাণিজ্যিক পরিচালন) কাওছার আমিন আলী চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারির প্রস্তাবটি তুলে ধরে বলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে প্রতি ইউনিটে ব্যয় ছিল ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। আর পাইকারি (বাল্ক) পর্যায়ে প্রতি ইউনিট সিরবরাহ করা হতো ৪ টাকা ৮৭ পয়সা। সেই হিসাবে ঘাটতি ছিল ৭২ পয়সা।

তিনি বলেন, কিন্তু বিগত এই কয়েক মাসে দুই ধাপে গ্যাসের দর বৃদ্ধি, তরল জ্বালানীর (ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল) ব্যবহার ও মূল্য বৃদ্ধি, সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যয় মেটাতে সরকার থেকে গৃহিত লোনের উপর ৩ শতাংশ সুদ পরিশোধ, বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুত ক্রয়সহ নানা ধরনের ব্যয়  বেড়েছে। ফলে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ইউনিট প্রতি ৫ দশমিক ৭২ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ইউনিট প্রতি ৪ দশমিক ৮৫ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে। এতে বিউবোর ইউনিট প্রতি লোকসান হচ্ছে ৮৭ পয়সা। সে কারণে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো প্রয়োজন বলে বিউবোর পক্ষে যুক্তি দেন কাওছার আমিন আলী।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ

বিউবোর জিএম (বাণিজ্যিক পরিচালন) বলেন, সরকার ভর্তুকি দেওয়ার কথা থাকলে ভর্তুকি না দিয়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এতে ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে এখন পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৬’শ ১০ কোটি টাকা। যার সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪’শ ৮১ কোটি টাকা। এতে করে বিউবো দিনদিন সংকটে পড়ছে।

এখন সংকট কাটতে অবচয় তহবিল থেকে ব্যয় পরিচালনা করতে হচ্ছে। অবচয় তহবিলে ২২ হাজার ৩’শ  ৭০ কোটি টাকা জমা থাকার কথা। কিন্তু জমা আছে ৩’শ ১৯ কোটি টাকা মাত্র। অর্থ সংকটের কারণে ওভারহোলিং রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ব্যহত হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কিন্তু প্রতি ইউনিটে ৮৭ পয়সা বাড়ানোর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ণ কমিটি। এই কমিটির সদস্য মো. কামরুজ্জামান বলেন, রেট বেজের ওপর গড়ে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ রিটার্ন বিবেচনা করলে আর্থিক সহায়তা ছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিউবোর নীট রাজস্ব চাহিদা প্রতি ইউনিটে ৫ টাকা ৪১ পয়সা। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৪ টাকা ৮৪ পয়সা। সেই হিসাবে ৫৭ পয়সা বাড়ানো যায়। অর্থাৎ ১১ দশমিক ৭৮ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তারা।

তবে এই মূহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চরম প্রতিবাদ জানিয়েছে কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল, ভোক্তা অধিকার সংগঠন-ক্যাবসহ নানা শ্রেণির-পেশার মানুষ।

গণশুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম প্রায় এক ঘন্টা বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলেন, বর্তমানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। বরং উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।

২০১৫ ও ২০১৬ এর একটি হিসেব দেখিয়ে তিনি বলেন, পাইকারী বিদ্যুতের বিদ্যমান মূল্যহার ৪  টাকা ৯০ পয়সা। বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ৭২ পয়সা। কিন্তু বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকিকে ঋণ হিসাবে বিবেচনা করায় সেই ঋণের সুদ বাবদ ২১ পয়সা এবং বিইআরসির নির্দেশনা মতে ফার্নেসওয়েলের পরিবর্তে ডিজেল ব্যবহার হওয়ায় রাজস্ব ঘাটতি ১৪ পয়সা। সব মিলিয়ে মোট দাঁড়ায় ৬১ পয়সা। কিন্তু বাড়ানোর কথা বলছে ৭২ পয়সা। এর সাথে অন্যান্য আরো বাড়তি খরচ দেখিয়ে মোট ৮৭ পয়সা বাড়ানোর জন্য বলছে বিদ্যুত বোর্ড। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানি
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানি

তিনি অভিযোগ করেন বিদ্যুৎ ইন্নয়ন তহবিলের অর্থের ব্যবহার না থাকায় সে অর্থ ‘নর্থ -ওয়েস্ট পাওয়র জেনারেশন কোম্পানীকে’ ধার দওেয়া হচ্ছে। স্বল্প ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে বিইআরসির আদেশ প্রতিপালিত হয়নি। কেন হয়নি? বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন ব্যর্থতার দায় কেন জনগণ নিবে-এমন প্রশ্ন তোলেন এই জ্বালঅনী বিশেষজ্ঞ।

গণশুনানি চলাকালে দাম বাড়ানোর বিপক্ষে টিসিবির সামনে কয়েকটি বাম রাজনৈতিক সংগঠন বিক্ষোভও করেছে।

শুনানিতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে জনগণের ওপরে একেবারেই অবিচার ও অন্যায়।

তিনি বলেন, বিদ্যুত মন্তণালয়ের উচিত দাম না বাড়িয়ে বরং কমানো। কারণ বিদ্যুতের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। এটা শুধু আমার নয়, ওয়ার্কাস পাটির দাবি।

বিদ্যুত নিয়ে ব্যবসা বন্ধের দাবি জানিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকী বলেন, জনগণের ওপর বাড়তি দাম চাপানো হবে সম্পূর্ণ অন্যায়।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিপক্ষে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ

গাইবান্ধার বিদ্যুৎগ্রাহক ও সেচ মোটরমালিক সমিতির জেলা সভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, বিদ্যুত কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাদের দুর্নীতি রোধ করা গেলে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

বিইআরসি আইন ২০০৩ অনুযায়ী, গণশুনানির পর ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। এর আগে সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এছাড়া ২০১০ এর ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ বছরে পাইকারি পর্যায়ে পাঁচবার ও খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে ৭ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সব শেষে বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, কত কম দামে গ্রাহককে বিদ্যুত সরবরাহ করা যায় সেটাই হবে আমাদের বিবেচনা।