বিপিএলের পঞ্চম আসরে পাঁচ বিদেশি খেলায় স্থানীয় ক্রিকেটারদের সুযোগ কমেছে। তবে বেড়েছে বিদেশি অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ারের সুযোগ। যে খেলোয়াড়টি জাতীয় দলের আঙিনায় আসতে পারেননি, বিপিএলের মঞ্চে তারও সুযোগ হচ্ছে সাঙ্গাকারা, গেইল, ম্যাককালাম, পোলার্ড, স্যামি, নারিনদের মতো তারকাদের কাছাকাছি যাওয়ার। তাদের কাছ থেকে কতটা শিখছেন দেশের উঠতি ক্রিকেটাররা?
প্রথম আসর থেকেই বিপিএলে যুক্ত আছেন সাবেক ক্রিকেটার হাসিবুল হোসেন শান্ত। এবার সিলেট সিক্সার্সের ম্যানেজারের ভূমিকায় সাবেক এই ফাস্ট বোলার। তার পর্যবেক্ষণে যা ধরা পড়েছে, ‘আমাদের স্থানীয়রা খুব কমই যায় বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতে। বিপিএল শেখার খুব বড় একটা জায়গা। কিন্তু তাদের কাছে গিয়ে শেখার তাড়না খুবই কম চোখে পড়ে। এটা খুব হতাশার যে এত বড় সুযোগ তারা মিস করছে। আমাদের সময় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ছিল না। আমরা এমন সুযোগ পাইনি। খেলোয়াড়দের উচিত আগ বাড়িয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলার, জানার।’
তারকাসমৃদ্ধ দল ঢাকা ডায়নামাইটসে খেলছেন জহুরুল ইসলাম অমি। বাস্তবতা ফুটে উঠল তার কথায়ও, ‘এদিক থেকে আমরা পিছিয়ে আছি, এটা স্বীকার করতে লজ্জার কিছু নেই। আমরা নিজেদের সাথে যতটা সাবলীল, বাইরের প্লেয়ারদের সাথে ওভাবে মিশি না। অন্য প্লেয়াররা এরকম না। হয়ত ইংল্যান্ডের প্লেয়াররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি, ভাষার ভিন্নতা হয়ত কিছুটা বাধা। তবে এই পর্যায়ের ক্রিকেটাররা সব দেশে খেলে অভ্যস্ত। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বললেও বুঝতে পারে। তারা সেভাবেই বিশ্লেষণ করে যেন আমরা সহজে বুঝতে পারি। আমরা আসলে শুরুর পদক্ষেপটা নিতেই পিছিয়ে যাই। কতটুকু ভাল ইংরেজিতে কথা বলতে পারব, কী মনে করবে, এমন সংশয় কাজ করে। ওরা অতিথি (বিদেশি খেলোয়াড়) হয়ে আমাদের দেশে এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই ওরা আশা করে আমরাই এগিয়ে যাব। আসলে আমাদেরই যাওয়া উচিত।’
বিপিএলে দারুণ পারফর্ম করে যাচ্ছেন ঢাকার টপঅর্ডার ব্যাটসম্যান জহুরুল ইসলাম। জানালেন সতীর্থ শ্রীলঙ্কান কুমার সাঙ্গাকারার এক বিশ্লেষণধর্মী ক্লাস পাল্টে দিয়েছে তার ব্যাটিংয়ের ধরন।
‘বিপিএলে প্রথমে সাত-আট নম্বরে ব্যাট করছিলাম, সুযোগ কম ছিল। সাঙ্গাকারাই আমাকে ডেকে বলল, তুমি উপরে ব্যাটিং করো আমি জানি। শেষে ব্যাটিং করছ হয়তবা ৫-৭টা বল পাচ্ছ। এরমধ্যেই তোমাকে নিজের নরমাল ব্যাটিংটা করতে হবে। বেশি শর্টস খেলতে যাচ্ছ, সাত বলে সাতটা চার মারা সম্ভব না। কিন্তু ৭ বলে ১০ রান করা সম্ভব। প্রত্যেক বলে সিঙ্গেল নাও, একটা বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করো। একটা বাউন্ডারি হবেই। প্রয়োজনে ৭ বলে ৮ নাও। এতেই স্ট্রাইকরেট ১১০ প্লাস হয়ে যায়। এটা করলেই যথেষ্ট। তুমি চেষ্টা করছ সাড়ে তিনশ-চারশ স্ট্রাইকরেট করার, এটা সম্ভব না। মারতে গিয়ে তুমি বল মিস করলে ৭ বলে ৩ রান বা ২ রান করবা, এতে টিম চাপে পড়বে।’
সাঙ্গাকারা সেদিন এটিও বলল, যখনই নামি বলটা যেন ঠিক দেখি, নরমাল ব্যাটিং করি। অতিরিক্ত কিছু করতে না যাই। ছয় মারার বলে এলে মারব। কিন্তু যদি জোরাজুরি করে মারতে যাই, সেটা কঠিন হয়ে যাবে। তার এ কথাগুলো আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। যখনই নামি, তিনটা বল খেললেও তো ভাল একটা রেজাল্টে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে দেখলে হবে না যে এক বলের জন্য নামছি। যে কয়টা বল পাই ইফেক্টিভ কিছু করতে হবে।
আগের দুই আসরেও ভাল করেছেন জাতীয় দলে খেলা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান জহুরুল। যখন যে দলেই খেলেছেন পেয়েছেন বড় বড় তারকা ক্রিকেটাদের। তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগও এসেছে।
‘অনেক ভাগ্যবান যে অভিজ্ঞ প্লেয়ারদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করি। এবার সাঙ্গাকারা আছে। গতবার চিটাগং ভাইকিংসে ছিল শোয়েব মালিক। তার আগেরবার রংপুর রাইডার্সে মিসবাহ–উল-হক। তাদের সঙ্গে কথা বললে অনেক কিছু জানা যায়। এগুলো হয়তবা আমি এখনও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি। তবে এই জানা, শেখাটা আমি হয়ত কোন ছোট ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। ওনাদের সঙ্গে কথা বললে অনেক তত্ত্ব পাওয়া যায়। তারা কীভাবে সফল হয়েছে, পুরোটা হয়ত ফলো করতে পারব না। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস অনুসরণ করা সম্ভব। একটা পয়েন্টে হয়ত আমার খেলার ধরনই বদল হয়ে যেতে পারে। এরকম কিছু ট্রিকস তারা দেয়। তারা দিতেই চায়। তারা আত্মকেন্দ্রিক না, চায় কথা বলতে। আমাদেরই দায়িত্ব জেনে নেয়ার।’
মারকাটারি ব্যাটসম্যান না হয়েও ভাল করছেন জহুরুল। বিপিএলের প্রতি আসরেই হাসে তার ব্যাট। বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে থেকে শিখেছেন খুঁটিনাটি অনেককিছু। পেয়েছেন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে সফলতার মন্ত্র। নিজের সেই টি-টুয়েন্টি দর্শনটাই জানালেন চ্যানেল আই অনলাইনকে।
‘এখানে টেকনিক বা অন্যকিছুর চেয়ে দরকার হল সাহসটা। কীভাবে চিন্তা করছেন সেটার উপর অনেককিছু নির্ভর করে। যদি খুব বেশি চিন্তা করি, এত বলে এত রান লাগে, ২০ ওভার শেষ হয়ে যাচ্ছে, দেখা যাবে দুইটা ডট হয়ে গেল। যারা বেশি চাপ নিয়ে নেবে, তারা এই ফরম্যাটে খেলতে পারবে না। যত সাবলীল থাকা যায়, প্রত্যেক বলেই আক্রমণাত্মক থাকতে হবে, তাহলে বল সিলেকশনটা সহজ হয়। কোনোদিন সফলতা আসতে পারে, আবার ব্যর্থতাও। কিন্তু প্রত্যেকদিন প্রত্যেক মুহূর্তে আক্রমণাত্মক থাকতে হবে।’
‘কেউ যদি একটু নেগেটিভ থাকে যে আজকে একটু ধীরে ধীরে খেলবে, আস্তে আস্তে সেট হবে, সেই সুযোগটা এখানে নেই। ধীরে ধীরে খেলতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে চাপ তৈরি করছে নিজের উপর। আক্রমণাত্মক থাকলে বল সিলেকশন সহজ হবে, অন্তত সিঙ্গেল বের করা সহজ হবে। আমরা টাইম নিতে যাই আর ভুলটা করি। হতে পারে প্রথম বলটাই চারের বল ছিল। ওটা মিস করে ফেললাম সময় নিতে গিয়ে। ওই চারটাই হয়ত মোমেন্টাম দিয়ে দিতে পারত। বড় ক্রিকেটাররা প্রথম বলে ছয় মেরে দেয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকে, যদি তেমন বল পায়। কোনোদিন ২৫টা বল পাব, কোনোদিন ৫টা। এই কম বলে কত ভাল রেজাল্ট করতে পারি সেটাই আসল।’ যোগ করেন জহুরুল।