চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিচারঃ মনের ভেতর আশার সঞ্চার

যশোরে থানার মধ্যে এক যুবককে বিচিত্র কায়দায় পিছমোড়া করে উল্টো ঝুলিয়ে রেখে টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়ার খবরে দুই পুলিশ সদস্যকে তলবের পাশাপাশি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। ওই ঘটনায় যশোর কোতয়ালি থানার এসআই নাজমুল ও এএসআই হাদিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কেন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। ওই দুই পুলিশ সদস্যকে ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে। যে যুবকের ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, সেই আবু সাঈদকেও সেদিন হাইকোর্টে হাজির করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদউল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ গত রবিবার (০৮.০১.২০১৭) স্বপ্রণোদিত হয়ে এই রুল জারি করেছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি, যশোরের এসপি, কোতয়ালির ওসি এবং দুই পুলিশ সদস্যকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকার খবরে এ কথা বলা হয়েছে।

খবরটা পড়ে মনের ভিতর কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে। যদিও আমার এক বন্ধু বলেন, বাংলাদেশের

যশোরে থানায় নির্যাতনের ছবি

মানবাধিকার কর্মীদের শরীরের জায়গায় জায়গায় উত্তাপ যন্ত্র বসানো থাকে। সেগুলো চার্জ হয় টাকায় বা বিশেষ বস্তুর ছোঁয়ায়। তাই একজন সন্ত্রাসী কিংবা মানবতাবিরোধী নিজামী, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলীরা সাজা পেলে দেশি বিদেশি মানবাধিকার কর্মীরা মহা ক্ষ্যাপা হয়ে যান। নামকরা আইনজীবীর মেয়ের বিদেশি স্বামীই তো আদাজল খেয়ে নামেন বিচারকে বিতর্কিত করতে, বিচারকদের চরিত্র হরণ করতে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করলে, তাদের পরিবারের মানবাধিকার নিয়ে মুখে কুলুপ আটে আমাদের দেশের ও বিদেশের মানবাধিকার কর্মীরা। ভাবটা এমন যে, সন্ত্রাসী বা মানবতাবিরোধী না হলে তাদের মানবাধিকার নেই। তাই তো এমপি লিটন হত্যার পরে মরহুম এমপি লিটন সাহেবের পরিবারের সদস্যদের কোনো মানবাধিকার নেই। ব্যতিক্রমী কিছু মানবাধিকার দেখা যায়। সেগুলোর খবর প্রচার করলে সরকার বা সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনী বিপদে পড়বে বা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে । যেমন মানবাধিকার ছিল ঐ ছেলেটির যার পায়ে গুলি লেগেছিল যখন এমপি লিটন নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। সেই গুলি লাগে এক নিরীহ বালকের পায়ে। ফলাফল এমপি লিটনের বৈধ অস্ত্র সীজ। সন্ত্রাসীরা তাদের মানবাধিকার প্রয়োগ করে নিজের বাসায় ঢুকে এমপি লিটনকে খুন করে এসেছে। এর আরেক নাম মানবাধিকার। তাই কোন মানবাধিকার কর্মী বা সংগঠন কোন বিবৃতি চোখে পড়ে না। কিন্তু গোলাম আজমের জন্য বয়সের বিবেচনায় আসে, ফাঁসি দেওয়ার সময়। কিন্তু তার নির্দেশে যখন মানুষ খুন করা হয় তখন কিন্তু বয়স বিচার করা হয়নি। তাদের নাবালক ছেলে-মেয়েদের মানবাধিকারের কী হবে তা বিবেচনা করা হয়নি।

যশোরে থানার মধ্যে যুবককে নির্যাতনের জন্য বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদউল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেছেন। এটা খুব আশার কথা। কারণ সব দেশেই আইন অপরাধের পিছে পিছে চলে। আইনে বলা হয় নি এমন ধরণের অপরাধ যখন কয়েকবার হয় তখন দেশে নতুন আইনের জন্ম হয়। যেমন হালের নারী নির্যাতন আইন, এসিড সন্ত্রাসের আইন, আইসিটি আইন, ইত্যাদি। আইন অনুপস্থিত থাকলে বিচারকগণ স্ব:প্রণোদিত হয়ে তার সুবিবেচনা থেকে বিচারের রায় দিয়ে থাকেন। এটাই আইনের ধারা বা নিয়ম সেই প্রাচীনকাল থেকেই। যা পরে, মানে সেই রায়ের পরে অনুরূপ মামলায় রেফারেন্স বা আইন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

এমপি লিটন

সাধারণ মানুষ যারা নির্যাতনের শিকার হন তারা অধিকাংশই কীভাবে থানায় অভিযোগ দাখিল করতে হয় তা জানেন না। তাই তারা থানায় গিয়ে সেখানে থাকা ‘বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত লেখক’দের দিয়ে অভিযোগ বা আবেদনপত্র লিখে সই করে দেন। অনেক সময় ‘লেখক’ তার ইচ্ছামত শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে আইনের ধারায় অনেক হেরফের হয়ে যায়। যা হোক, এর উপর ভিত্তি করেই থানা থেকে এফআইআর তৈরি হয়ে যায় আদালতের বিচারকের কাছে। বিচারক অনুমতি দিলে তার উপর ভিত্তি করে থানার ওসি’র নিয়োজিত তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে চলে তদন্ত, দরকার হলে আসামী গ্রেফতার হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৬১ ধারায় এলাকাবাসীর জবানবন্দি, অকুস্থলে গিয়ে অপরাধ সংঘটনের স্থানের ম্যাপ করে, আলামত ইত্যাদি সংগ্রহ করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, এসপি বা ডিসি’র সাক্ষর নিয়ে আবার আদালতে জমা দেওয়া হয়। আদালত তা যদি গ্রহণ করেন তবেই মামলার চার্জ গঠন করা হয়। এরপরে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে সাফাই সাক্ষী থাকলে তাও শেষ করা হয়, এরপরে শুরু হয় মামলার যুক্তিতর্ক। সব শেষে রায়। এটা একটা বিরাট প্রক্রিয়া। যার একটা ধাপে ভুল করা হলেও আসামী খালাস পেয়ে যেতে পারে। তখন বদনাম হয় বিচারকের, পুলিশের, উকিলের ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা অনেকটা আমাদের দেশের গার্মেন্টস প্রডাকশনের মতো। সুতা, কাপড়, রঙ, পোশাক ডিজাইন মতো কাটা, সেলাই, বিভিন্ন ধরণের ট্যাগ লাগানো, আলগা সুতা কেটে ফেলা, ইস্ত্রি, সাইজ অনুযায়ী প্যাকেজিং করা, সময় মতো রপ্তানী করা, ইত্যাদির কোন একটা স্তরে ভুল হলেই শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যায়। পুরোটাই তখন লস। কে কার দোষ দেবেন! দিলেই বা কী লাভ!

তাই বাংলাদেশের আদালতের মামলায় বিচারকগণের বিশেষ যত্নবান ভূমিকা ছাড়া ন্যায় বিচার পাওয়া খুব কঠিন বিষয়। আইনের উপযুক্ত ধারার বা নির্দেশনার অনুপস্থিতিতে বিচারক নিজের ন্যায়পরায়ণতা ব্যবহার করে সুবিবেচনায় জারিত হয়ে রায় দিতে পারেন। যা ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে আমাদের দেশে। তাই যখন দেখি যে, কোন অপরাধের বিষয়ে বিচারকগণ স্ব:প্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন তখন আশার আলো দেখি। লেখাটা যখন শেষ করার কথা ভাবছি তখন সহকর্মীর মেবাইলে রিংটোন বাজছে ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে ……………………………’।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)